শ্যামসুন্দর ঘোষ,কালনা(পূর্ব বর্ধমান),২৬ ডিসেম্বর : পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি শুধু রাজনীতির আঙিনায় নয়, সরকারি স্কুলগুলোতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে । টাকার বিনিময়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের কাছে নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে আগ্রহী নয় অভিভাবকরা । যে কারণে এরাজ্যের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব বেশ বেড়ে গেছে সাম্প্রতিক সময়ে । এদিকে রাজ্যের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে পড়ুয়াদের আকাল পড়ে গেছে । পড়ুয়ার সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে প্রলোভন দেখিয়ে পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করতে রীতিমত প্রচার চালাতে দেখা গিয়েছিল পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি-২ ব্লকের বোহার পঞ্চায়েত এলাকার একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের । এবারে জেলার কালনা অম্বিকা মহিষমর্দিনী উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও একই রাস্তায় হাঁটলো । তবে তারা প্রলোভন দেখিয়ে প্রচার না করে পড়ুয়াদের নজিরবিহীন অভ্যর্থনা জানিয়ে এবং নগদসহ বিভিন্ন উপহার তুলে দিয়ে পড়ুয়াসহ অভিভাবকদের খুশি করার চেষ্টা করলেন ।
আজ বৃহস্পতিবার কালনা অম্বিকা মহিষমর্দিনী উচ্চ বিদ্যালয়ে কৃতি পড়ুয়াদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল । প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী পড়ুয়াদের কপালের চন্দনের তিলক পড়ানো হয় । গলায় উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে বরন করেন খোদ স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক দেব প্রসাদ বাগ । স্কুলের তরফে প্রত্যেক পড়ুয়ার হাতে একটি করে নগদ টাকা,শংসাপত্র এবং একটা করে বিশেষ পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এতে পড়ুয়ারা খুব খুশি । খুশি তাদের অভিভাবকরাও।
কিন্তু হঠাৎ কেন এই উদ্যোগ ?
এই প্রশ্নের উত্তরে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রশান্ত রায় কোনো রাখঢাক না করে বলেই ফেললেন,’মানুষের মনে সরকারি স্কুলের প্রতি যে অনীহাটা তৈরি হয়েছে, বেসরকারি স্কুল থেকে পড়ুয়াদের সরকারি স্কুলমুখী করার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি ।’ তিনি আরও বলেন,’আমরা আসলে চাইছি ছাত্রদেরকে আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করতে । যাতে তারা স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে ।’ এদিকে স্কুলের এই নজিরবিহীন ‘খাতিরে’ আপ্লুত হয়ে গেছে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র আয়ূষ দাস । ক্যামেরার সামনে ওই পড়ুয়া বলে,’আগে কোনদিন আমাদের এভাবে খাতির যত্ন করা হয়নি । খুব ভালো লাগছে আজ ।’
প্রসঙ্গত,স্কুলে আচমকা কোন অনুষ্ঠান করে পড়ুয়াদের হাতে নগদ টাকা, পুরস্কার তুলে দেওয়ার নজির ইতিপূর্বে দেখা যায়নি । পড়ুয়াদের যেভাবে রাজকীয় অভ্যর্থনায় জানানো হলো তাও এক অর্থে নজিরবিহীন । স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার প্রভাব গ্রাম বাংলার সন্তানদের বাবা-মায়ের ওপরেও পড়েছে। যে কারণে তারা ‘ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া’ শিক্ষকদের কাছে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে পাঠাতে চাইছেন না । কারণ তারা মনে করছেন যে এতে তাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে । তাদের এই দাবি যে নিছক অমূলক নয় তা দেখা গিয়েছিল কত বুধবার মেমারিতে । পড়ুয়ার আকাল দেখা দেওয়ায়
শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগে পড়ুয়ার সন্ধান পেতে টোটোয় চেপে গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার করেছিলেন স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা । তার সাথে তাঁরা তুলে ধরছেন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে পড়ুয়াদের প্রাপ্তি যোগের ফিরিস্তি। টোটোর পিছনে ঝোলানো থাকে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে পড়ুয়াদের কি কি প্রাপ্তি লাভ হবে,,তার ফিরিস্তি সংক্রান্ত ফ্লেক্স। সেইসব টোটোয় চড়ে শিক্ষকরা বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘোরেন। তার সাথে মাইক ফুঁকে তাঁরা এলাকার প্রতিটি বাড়ির ছেলে মেয়েকে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে আবেদন রেখে চলেন।বিনামূল্যে বই,স্কুলের পোষাক, জুতো, মুখরোচক মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা এবং বৃত্তিসহ নামান সরকারী সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয় ।
পড়ুয়ার আকাল কাটাতে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এভাবে পথে নামতে দেখে বোহার-২ পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই হতবাক হন।আবার কেউ কেউ শিক্ষকদের এমন ভূমিকায় দেখে প্রশংসাও করেন। তবে শিক্ষকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নতুন শিক্ষাবর্ষে বোহারের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলিতে পড়ুয়া ভর্তির হিড়িক পড়বে, এমন কোন আভাস অবশ্য এখনও পর্যন্ত মেলেনি।।