এইদিন ওয়েবডেস্ক,সিরাজগঞ্জ,১০ জুন : বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়িতে জিহাদি হামলার ঘটনা ঘটেছে । আজ মঙ্গলবার দুপুরে জিহাদির দল আচমকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়িতে চড়াও । সেই সময় গেটের সামনে প্রচুর পর্যটক দাঁড়িয়ে ছিল । জিহাদিরা পর্যটকদের মারধর করে তাড়িয়ে দেয় । তারপর তারা গেট ভেঙে কাছারি বাড়ির অডিটোরিয়ামে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। ভেঙে ফেলা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরাম কেদারা, ব্যবহার করা আয়না, খাট এবং অন্যান্য জিনিষপত্র । যদিও বাংলাদেশের প্রথম শাড়ির সংবাদ মাধ্যমগুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়িতে জিহাদি হামলার খবর করেনি ।
প্রসঙ্গত,সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের একটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় পুরাকীর্তি হচ্ছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহজাদপুরের কাচারিবাড়ী। এটি রবীন্দ্রনাথের পৈতৃক জমিদারি তত্ত্বাবধানের কাচারি ছিল। তারও পূর্বে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এটি নীলকরদের নীলকুঠি ছিল। সে কারনে এখনও অনেকে একে কুঠিবাড়ী বলে। পরে রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এটি নিলামে কিনে নেন। এখানে রয়েছে জমিদারির খাজনা আদায়ের কাচারির একটি ধ্বংসাবশেষ, একটি বেশ বড় দ্বিতল ভবন। এখানে নির্মিত হয়েছিল একটি আধুনিক অডিটোরিয়াম। দ্বিতল ভবনটি বর্তমানে রবীন্দ্র জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং আঙ্গিনার বিস্তৃত জায়গা জুড়ে তৈরী করা হয়েছে সুদৃশ্য একটি ফুলবাগান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতার আদেশে ঊনত্রিশ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে জমিদারি তত্ত্বাবধানের জন্য প্রথম শাহজদাপুর আসেন। এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের বিচিত্র জীবন প্রবাহের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হন তিনি । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯০ থেকে ১৮৯৬ মোট ৭ বছর জমিদারির কাজে শাহজাদপুরে আসা-যাওয়া এবং অবস্থান করেছেন।তার এই শাহজাদপুরে আসা-যাওয়া শুধু জমিদারি তত্ত্বাবধানের বস্তুনিষ্ঠ প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং এই জমিদারির প্রয়োজনকে ছাপিয়ে প্রাধান্য পেয়েছে কবির সাহিত্য সৃষ্টির অনুপ্রেরণা ও সৃজনশীলতা। এই সময়ের মধ্যে এখানে তিনি তাঁর অনেক অসাধারণ কালজয়ী সাহিত্য রচনা করেছেন। এর মধ্যে ‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘ভরা ভাদরে’, ‘দুইপাখি’ ‘আকাশের চাঁদ’, ‘হৃদয় যমুনা’, ‘প্রত্যাখ্যান’, ‘বৈষ্ণব কবিতা’, ‘পুরস্কার’ ইত্যাদি অসাধারণ কবিতা রচনা করেছেন। ‘চৈতালী’ কাব্যের ‘নদীযাত্রা’, ‘শুশ্রূষা’,‘ইছামতি নদী’, ‘বিদায়’, ‘আশিস-গ্রহণ’ ইত্যাদি কবিতা এবং ‘কল্পনা’ কাব্যের ‘যাচনা’, , ‘বিদায়’, ‘নরবিরহ’, ‘মানস-প্রতিমা’, ‘লজ্জিতা’, ‘সংকোচ’, ইত্যাদি বিখ্যাত গান রচনা করেছেন। তাঁর শাহজাদপুরে রচিত ছোটগল্পের মধ্যে ‘পোষ্টমাস্টার’, ‘ছুটি’, ‘সমাপ্তি’, ‘অতিথি’ ইত্যাদি বিখ্যাত। আর প্রবন্ধের মধ্যে ‘ছেলে ভুলানো ছড়া’, ‘পঞ্চভূত’, এর অংশবিশেষ এবং ‘ছিন্নপত্র’ ও ছিন্নপত্রাবলীর আটত্রিশটি পত্র রচনা করেছেন। এছাড়া তার ‘বিসর্জন’ নাটকও এখানে রচিত। সবচেয়েবড় কথা, তার পরবর্তী সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে শাহজাদপুরের প্রভাব বিশেষভাবে বিদ্যমান।
ঠাকুর পরিবারে জমিদারি ভাগাভাগির ফলে শাহজাদপুরের জমিদারি চলে যায় রবীন্দ্রনাথের অন্য শরীকদের হাতে। তাই ১৮৯৬ সালে তিনি শেষ বারের মতো শাহজাদপুর থেকে চলে যান। এর পরে তিনি আর শাহজাদপুরে আসেননি।শাহজাদপুর ছিল কবিগুরুর অত্যন্ত প্রিয় এবং ভালোবাসার একটি স্থান। তাঁর ভালোবাসার কথা তিনি বিভিন্ন লেখায় বিশেষ করে ‘ছিন্নপত্র’ ও ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে গভীর আবেগ এবং আন্তরিকতার সাথে উল্লেখ করেছেন। ১৮৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শাহজাদপুর থেকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ‘এখানে (শাহজাদপুরে) যেমন আমার মনে লেখার ভাব ও ইচ্ছা আসে এমন কোথাও না।’ (ছিন্নপত্র- পত্র সংখ্যা-১১৯)
এছাড়াও অন্যান্য লেখাতেও শাহজাদপুর সম্পর্কে তাঁর আবেগময় ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে ১৯৪০ সালে শাহজাদপুরের তৎকালীন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হরিদাস বসাকের চিঠির জবাবে তিনি লিখেছেন,‘শাহজাদপুরের সাথে আমার বাহিরের যোগসূত্র যদিও বিচ্ছিন্ন তবুও অন্তরের যোগ নিবিড়ভাবে আমার স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। আমার প্রতি সেখানকার অধিবাসীদের শ্রদ্ধা এখনো যদি অক্ষুন্ন থাকে তবে আমি পুরস্কার বলে গণ্য করব’ (শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ-মোহাম্মদ আনসারুজ্জামান)। শাহজাদপুরের প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ভালবাসা একে দিয়েছে মর্যাদা ও গৌরবের এক ভিন্ন মাত্রা। শাহজাদপুরও রবীন্দ্রনাথকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে হৃদয়ে লালন করছে। প্রতিদিন দেশ বিদেশ থেকে বহু দর্শনার্থী কবির স্মৃতিধন্য এই স্থানটি দর্শনে আসেন। কিন্তু আজকের জিহাদী হামলার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়িতে আসতে পর্যটকরা ভয় পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে ।।

