দিব্যেন্দু রায়,কেতুগ্রাম(পূর্ব বর্ধমান),০৩ নভেম্বর : শতাব্দী প্রাচীন ধরে একই রীতি মেনে পূজো হয়ে আসছে পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামের মালগ্রামের মুখোপাধ্যায় পরিবারের জয়কালীর । দেবীর ভোগে দেওয়া নিয়ম চ্যাঙমাছ পোড়া আর লাউ-চিংড়ি মাছের তরকারি । এছাড়া অমাবস্যার পূজোর রাতে কেবল একটিমাত্র বলিদান প্রথা রয়েছে । শুধু পূজোর নিয়মই নয় পূজোর সূচনা, এমনকি জয়কালী বিগ্রহ নির্মানের পিছনেও রয়েছে অনেক প্রাচীন রোমাঞ্চকর কাহিনী । পরিবারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে,বর্তমান জয়কালী মূর্তিটি একটি মাত্র পাথরকে খোদাই করে নির্মিত । নির্মান করেছিলেন দাঁইহাটের বাসিন্দা প্রসিদ্ধ নবীন ভাস্কর । পারিবারিক হলেও মালগ্রামের জয়কালীর পূজো ঘিরে এলাকাবাসীর মধ্যেও চরম আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় ।
পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রাচীন কালীপূজোগুলির মধ্যে অন্যতম কেতুগ্রামের আগরডাঙ্গা অঞ্চলের মালগ্রামের মুখোপাধ্যায় পরিবারের জয়কালীর পূজো । এই পূজোর সূচনা হওয়ার পিছনে জড়িয়ে আছে প্রাচীন কাহিনী ।পরিবারের সদস্য অর্ণব মুখোপাধ্যায়, প্রবীনানন্দ মুখোপাধ্যায়রা জানান, পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে জানা গেছে প্রায় ৪০০ বছর আগে মুখোপাধ্যায় পরিবারে দূর্গাপূজোর প্রচলন ছিল । কিন্তু ১৭০-৮০ বছর আগে দূর্গাপূজোর নবমীর দিন ঘটে যায় একটি অলৌকিক ঘটনা । দেবী মুখ আচমকা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে । পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে । কি করনীয় জানতে পরিবারের লোকজন তখন কুলগুরু পাচুন্দির ভট্টাচার্য বাড়িতে যায় । কিন্তু ঘটনার কথা শুনে গুরু পরিবারের সদস্যরা তাঁদের ভাটপাড়ার পন্ডিতদের কাছে পরামর্শ নিতে বলেন । যদিও ভাটপাড়ার পন্ডিতরাও স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারেননি । শুধু পূজো চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভাটপাড়ার পন্ডিতদের তরফ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয় । তারপর পন্ডিতদের পরামর্শে দূর্গাপূজো চলতে থাকে । ইতিমধ্যে দেবীর স্বপ্নাদেশ হয় । স্বপ্নে দেবী নির্দেশ দেন দাঁইহাটে তাঁর মূর্তি তৈরি হয়ে আছে । ওই মূর্তিতে পূজো করতে হবে ।
তাঁরা জানান, সেই সময়ে দাঁইহাটের নবীন ভাস্করের নাম দেশ জোড়া । তিনিই দক্ষিনেশ্বরের ভবতারিনীর মূর্তির নির্মান করেছিলেন । সমসাময়িক কালে বিহারের এক ব্যক্তি কষ্টি পাথরের কৃষ্ণমূর্তি তৈরির বায়না করে গিয়েছিলেন । একটি মাত্র পাথরে খোদাই করে মূর্তি তৈরি করছিলেন ওই শিল্পি । কিন্তু তিনি কৃষ্ণমূর্তি নির্মানের পরিবর্তে ভূল বশত একটি মূর্তি তৈরি করে ফেলেন । পরে নবীন ভাস্করকে দেবী স্বপ্নাদেশ দেন মালগ্রামের লোকজন এসে মূর্তিটি নিতে আসবে । তিনি যেন মূর্তিটি তাঁদের হাতে তুলে দেন । তারপর মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা দাঁইহাটে গিয়ে একটি পাথরে খোদাই করে তৈরি করা কালী মূর্তিটি আনেন ।
এদিকে তামিলনাড়ু থেকে পন্ডিত বিধান নিয়ে দূর্গাপূজো শেষে দূর্গামূর্তিটি পূজোস্থলেই সমাধিস্থ করা হয় । মূর্তিকে সমাধিস্থ করার জন্য সময় পাথরের মঙ্গলচন্ডীর মূর্তি উঠে আসে । মূর্তি সমাধিস্ত করার পর সেই জায়গায় বেদী তৈরি করে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন জয়কালী মূর্তির প্রতিষ্ঠা করা হয় । দেবীর নির্দেশে নামকরন হয় দেবী জয়কালী । সেই থেকেই মুখোপাধ্যায় পরিবারে দেবী জয়কালী পূজো শুরু হয় । পরে কোনও সাধক এসে দেবীর ওই বেদিটিকে পঞ্চমুন্ডির আসনে রুপান্তরিত করেন ।
মুখোপাধ্যায় পরিবারে দেবী জয়কালীর পূজোর রীতিনীতিও অনান্য পারিবারিক কালীপূজো থেকে পৃথক করে রেখেছে । পরিবারের সদস্য বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমাদের কূলদেবীর পূজোয় বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় । তার মধ্যে দেবীকে ভোগের সঙ্গে চ্যাঙমাছ পোড়া আর লাউ-চিংড়ি মাছের তরকারি দেওয়া নিয়ম । ঘটে জলের ব্যাবহার করতে হয় কারন বারি । অমাবস্যার রাতে পূজোয় একটি মাত্র ছাগ বলি দেওয়া নিয়ম । প্রতিপদের দিন মানসিকের বলি হয় ।’ তিনি বলেন, ‘মুখোপাধ্যায় পরিবারের দেবী জয়কালী খুবই জাগ্রত । আমার বর্তমানে ৭৫ বছর বয়স । আমার যখন ২০-২২ বছর বয়স তখন আমাদের সকলের সামনে ঘটেছিল এক অলৌকিক ঘটনা । কালীপূজোর রাতে কোনও এক বংশধরের জেদের কারনে একটির পরিবর্তে দুটি ছাগ বলি দেওয়ার চেষ্টা হয় । কিন্তু প্রথম ছাগ বলি দিতে গিয়ে কর্মকারের হাত-পা কাঁপতে শুরু করে । যতবার ছাগের হাড়ে খর্গ চালায় ততবারই খর্গ স্পিংয়ের মত ছিটকে যায় । ৫-৬ বারের চেষ্টায় ব্যার্থ হওয়ার পর শেষে সেই ছাগকে ছেড়ে দিতে হয় । আর তারপরেই আমার দাদা অলকানন্দ মুখোপাধ্যায় মূর্ছিত হয়ে যায় । সেই থেকে দেবীর পূজোয় প্রাচীন রীতির কোনও অন্যথা করা হয় না । শুধু কালীপূজতেই নয় দূর্গাপূজোর নবমীর দিন জয়কালীর পূজো হয়। রয়েছে ছাগ বলিদান প্রথাও ।’
পাশাপাশি তিনি জানান,পরিবর্তী কালে দেবীর মন্দির নির্মান করা হয় । ওই মন্দিরের পাশে একটি বেলগাছ ছিল । একবার সাধক বামাখ্যাপা মালগ্রামে এসে ওই বেলগাছের নিচে পঞ্চমুন্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে সাধনাও করেছিলেন । তিনি দু’এক দিন ছিলেন । কিছু অলৌকিক ঘটনাও ঘটিয়েছিলে । পরে প্রাচীন বেলগাছটি শুকিয়ে যায় ।
জানা গেছে,মুখোপাধ্যায় পরিবারে দেবী জয়কালীর বাৎসরিক পূজোর ছাড়া নিত্যসেবা হয় । ৬-৭ জন শরিক মিলে নিত্যসেবার বাৎসরিক পূজো চালান । ৫-৭ বছর অন্তর এক একজনের পালা পড়ে । কালীপূজো ও দূর্গাপূজোর নবমীর দিন পরিবারের সকল সদস্য এক জায়গায় জড়ো হন । কালীপূজোর পরের দিন অন্নকূটের আয়োজন করা হয় ।।