এইদিন ওয়েবডেস্ক,বাংলাদেশ,১০ জানুয়ারী : শেখ হাসিনার দেশ ছাড়া হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের হিন্দুরা ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠীদের নিশানায় চলে এসেছে । বাংলাদেশ থেকে হিন্দুকে নিশ্চিহ্ন করতে অবর্ণনীয় নিপীড়ন চালাচ্ছে ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি । প্রাণ বাঁচাতে ইতিমধ্যে বহু হিন্দু ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে । এই পরিস্থিতিতে ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জামাত ইসলামির একজন নেতার একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে । সেই ভিডিওতে ওই জামাত জঙ্গিকে হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করতে ‘শাহজাহানের বংশধরদের হাতে তরবারি’ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানাতে শোনা যায় ৷
ভিডিওতে ইমরান হুসাইন সিরাজী নামে জামাত ইসলামের ওই জঙ্গি বলেছে,’এটা কিন্তু ভারতের গুজরাট নয় । এটা কিন্তু সিকিম নয় । এটা কিন্তু কাশ্মীর নয় । এটা কিন্তু হায়দ্রাবাদ নয় । এটা ১৪ কোটি মুসলমানের জন্মভূমি কিনা বলেন ? এটা ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ১৪ কোটি মুসলমানের জন্মভূমি । এখানে যদি কেউ কোন সময় গৌরগোবিন্দের ভূমিকা পালন করতে যাও তাহলে আমরা শাহজাহানের সন্তানেরা বসে থাকব না । শাহজাহানের সন্তানের হাতে তরবারি উঠবে । এই তরবারি আর নামবে না । এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলে একটা হিন্দু থাকতে দেওয়া হবে না । হবে না হবে না।’
প্রসঙ্গত,বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যার সংখ্যা ১৯৪৭ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। এরকম চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা শুন্যের কোটায় না পৌছালেও পাকিস্তানের দশা তো হবেই। এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ, যেমন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, জবরদখল, এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিবাসন। সরকারি আদমশুমারি এবং গবেষণা অনুযায়ী,১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি ও ভারত- পাকিস্তান বিভক্তি প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) তখনকার হিন্দু জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২২%-৩০% । ১৯৫১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা কমে ২২%-২৩% আসে । কারণ দেশভাগের পর কিছু হিন্দু পরিবার ভারতে অভিবাসন করে। ১৯৬১ সালে বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৮.৪%-এ ।কারণ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং বৈষম্যের কারণে অভিবাসন বৃদ্ধি । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়কালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল আনুমানিক ১৩.৫%-১৪% । আর এর কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু সম্প্রদায়কে পাকিস্তানি বাহিনী বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করে। একাধিক গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে লক্ষাধিক হিন্দু পরিবার ভারতে আশ্রয় নেয় । স্বাধীনতার পরেও সাম্প্রদায়িক হামলা, সম্পত্তি অধিগ্রহণ, এবং সাম্প্রতিক আইন যেমন “শত্রু সম্পত্তি আইন” (যা ২০০১ সালে “ভূমি সংরক্ষণ আইন” হিসেবে পরিবর্তিত হয়) হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর প্রভাব ফেলে। এজন্য ১৯৮১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১২.১% । রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার জন্য ১৯৯১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা কমে হয় ১০.৫% । এরপরেও বৈষম্য এবং নির্যাতন অব্যাহত থাকায় অনেকেই ভারত বা অন্য দেশে চলে যান এবং ২০০১ বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যা হয় ৯.২% । পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক চাপ, সামাজিক নিপীড়ন এবং সীমান্তে চলমান অভিবাসন চলতে থাকায় ২০১১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা হয় ৮.৫%।
২০২২ সালে হিন্দু জনসংখ্যা আনুমানিক ৭.৯%-৮% ছিল । ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি হওয়া সহিংসতার বিচার না হওয়া, ভূমি জবরদখল এবং নিরাপত্তার অভাবের কারনে বহু হিন্দু ভারতে পালিয়ে আসে ।
বাংলাদেশে ১৯৪৭-২০২৪ পর্যন্ত হিন্দু জনসংখ্যার হ্রাসের মূল কারণগুলি হল :
দেশভাগ ও যুদ্ধ: ১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপক অভিবাসন,লাগাতার হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও দাঙ্গা,শত্রু সম্পত্তি আইন এবং অন্যান্য বৈষম্যমূলক আইনি বৈষম্য ব্যবস্থা,
চাকরি, শিক্ষা, ও সম্পত্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়া এবং নিরাপত্তাহীনতা । বাংলাদেশের অভিজ্ঞমহল মনে করছেন যে হিন্দু জনসংখ্যার ক্রমহ্রাস রোধ করার উপায় হল : একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এটি ধর্ম, জাতি, বা বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য নিরাপত্তা, সমানাধিকার, এবং সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সম্ভব । তারা এই বিষয়ে কিছু সুপারিশও করেছেন । সেগুলি হল :
১. আইনের শাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন: বিশেষ ট্রাইব্যুনালে সংখ্যালঘু নির্যাতনের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন করতে হবে। অভিযুক্তের অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় এই আইনে গুরুতর অপরাধের জন্য জামিন অযোগ্য ধারা থাকতে হবে।
- ধর্মীয় সহিংসতা বন্ধ করা: সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বা নিপীড়ন দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।
- বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা: হিন্দু সম্প্রদায়ের জনবহুল এলাকায় পুলিশের নজরদারি এবং তৎপরতা বাড়ানো।
- আইন সংশোধন: শত্রু সম্পত্তি আইনসহ যেকোনো বৈষম্যমূলক আইন বাতিল করা বা সংশোধন করে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করা।
২. সম্পত্তির অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা - ভূমি জবরদখল বন্ধ: সংখ্যালঘুদের জমি বা সম্পত্তি অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
- আইনগত সহায়তা: ভূমি দখল বা সম্পত্তি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে সহজে প্রবেশযোগ্য এবং কার্যকর আইনগত সহায়তা প্রদান।
৩. সামাজিক সংহতি ও শিক্ষা প্রচার করা - ধর্মীয় সম্প্রীতি: বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মসূচি চালু করা।
- ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা: পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও সহনশীলতার গুরুত্ব তুলে ধরা।
- সাংস্কৃতিক সংহতি: হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়ানো।
৪. রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও ক্ষমতায়ন - রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: সংখ্যালঘুদের স্থানীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
- কোটা ব্যবস্থা: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা, চাকরি, এবং সরকারি পদের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত কোটা চালু করা।
৫. অর্থনৈতিক উন্নয়ন - ব্যবসা ও কর্মসংস্থান: সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক কর্মসূচি এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগে সহজ ঋণপ্রদান।
- চাকরিতে বৈষম্য দূরীকরণ: ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কর্মসংস্থানে ন্যায়সঙ্গত সুযোগ তৈরি।
৬. মানসিকতা পরিবর্তনে প্রচারণা চালানো - গণমাধ্যমের ভূমিকা: টিভি, রেডিও, ও সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও মানবাধিকার নিয়ে ইতিবাচক প্রচারণা চালানো।
- ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা: মসজিদ, মন্দির, ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থান থেকে সম্প্রীতির বার্তা প্রচার করা।
৭. আন্তর্জাতিক সহায়তা ও পর্যবেক্ষণ - আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংগঠন, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা নেওয়া।
- নিরীক্ষা ও প্রতিবেদন: সংখ্যালঘুদের অবস্থার ওপর নিয়মিত প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশ করা।
৮. সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা - ধর্মনিরপেক্ষতা: সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং এর কার্যকর প্রয়োগ।
- ন্যায়বিচার: সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষায় সংবিধানের ধারা প্রাসঙ্গিকভাবে প্রয়োগ করা।
৯. সংখ্যালঘু-বান্ধব প্রশাসন তৈরি - সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়: একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় তৈরি করে সংখ্যালঘুদের সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।
- বিশেষ কমিশন: সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় স্বাধীন কমিশন গঠন।
এই সব উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়সহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমে যাওয়ার হার রোধ করা সম্ভব এবং তাদের জন্য নিরাপদ, সমৃদ্ধ, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা ।।