প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৬ ফেব্রুয়ারী : জন্মের সময় থকেই দুটি হাত থেকেও যেন নেই । খর্বকায় দুটি হাতেই নেই তালু, নেই আঙুলও।কিন্তু তাতে আর কি যায় আসে। শিক্ষক হবার স্বপ্নে বিভোর ছাত্র জগন্নাথ মাণ্ডি পা দিয়ে লিখেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে ।পরীক্ষায় সফল হওয়ার ব্যাপারেও ষে দৃঢ়প্রত্যয়ী। লেখাপড়া শেখার জন্য বিশেষ ভাবে সক্ষম আদিবাসী পরিবারের এক ছাত্রের এহেন লড়াইকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারেন নি পরীক্ষা কেন্দ্রের পরীক্ষকরা।
মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী জগন্নাথ মাণ্ডির বাড়ি মেমারি
থানার সিমলা গ্রামের আদিবাসী পাড়ার।তাঁর শৈশব জীবন খুব একটা সুখের ছিল না । ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মেছে জেনেও ছোট বেলাতেই তাঁকে ছেড়ে চলে যায় মা । তবে মা ছেড়ে চলে গেলেও বাবা, বৃদ্ধা ঠাকুমা এবং পিসি ও দাদার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় নি জগন্নাথ । এনাদের পরম স্নেহে জগন্নাথ লালিত পালিত হয়। এনারা লেখাপড়া শেখার প্রতি জগন্নাথকে ছোট বয়স থেকেই আগ্রহী করে তোলেন। ভর্তি করেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । তখন থেকেই পা দিয়ে বাংলায় লেখা রপ্ত করতে শরু করে জগন্নাথ । সময় গড়ানোর সাথে সাথে জগন্নাথ পা দিয়ে লেখাতে সাবলীল হয়ে ওঠে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ সম্পূর্ণ হলে পরিবারের লোকজন জগন্নাথকে ভর্তি করে মেমারির নুদীপুর ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরে।সেখানে একের পর এক ক্লাসে উত্তির্ণ হয়ে এবার জগন্নাথ দিচ্ছে মাধ্যমিক পরীক্ষা । সব থেকে বড় সিমলা আদিবাসী পাড়া থেকে জগন্নাথই একমাত্র ছাত্র যে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে।এমন এক ছাত্রের পরীক্ষা দিতে যাতে কোন অসুবিধা না হয় তার জন্য সদা সতর্ক পরীক্ষাকেন্দ্র মেমারির বাগিলা পূর্ণচন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের পরীক্ষকরা। লেখাপড়া শেখার জন্য
জগন্নাথের এই কঠিন লড়াইকে তারাও কুর্নিশ জানিয়েছেন।
নুদীপুর ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের শিক্ষকরাও
জগন্নাথের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ।প্রধান শিক্ষক কিশোর ঘোষাল বলেন,’জগন্নাথ খুব ভালো ছেলে।লেখা পড়ার ব্যাপারেও ও খুব সচেতন।ওর ব্যবহার মুগ্ধ করে স্কুলের সকল শিক্ষক ও সহপাঠীদের।
কিশোর বাবু আরো বলেন, জগন্নাথ অত্যন্ত দুর্বল
আর্থিক পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া শেখার ব্যাপারে ছোট বয়স থেকেই ওর বৃদ্ধা ঠাকুমা ওকে অনুপ্রাণিত করে যান।সেই প্রেরণায় শত কষ্টের মধ্যেও জগন্নাথ লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। স্কুলে পড়াশুনা করার পশাপাশি সে গ্রামের একজন প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে যেত । পায়ে চামচ নিয়ে স্কুলে মিডডে মিল খাওয়া জগন্নাথ ভালো ফুটবলও খেলার পাশাপাশি পায়ে করে খুব ভালো ছবিও আঁকে।তাঁর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে স্কুলে ক্লাস করা ও লেখা লেখির জন্য স্কুলের তরফে বিশেষ বেঞ্চের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় । স্কুলে সহপাঠীরা সবসময় জগন্নাথের পাশে থাকে।বেশিরভাগ দিন সহপাঠীরা তাঁদের সাইকেলে জগন্নথকে চাপিয়ে নিয়ে স্কুলে আসতো। প্রধান শিক্ষক এও জানান,পায়ে করে লিখে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য জগন্নাথ যাতে অতিরিক্ত সময় পায়
তারজন্য পর্শদে আবেদন আনানো হয়। পর্শদ তা অনুমোদন করেছে’। মাধ্যমিক পরীক্ষায় জগন্নাথ
যে সাফল্যের সঙ্গেই উত্তির্ণ হবে সেই ব্যাপারে
একপ্রকার নিশ্চিৎ বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকরা ।
সিমলা গ্রামের বাসিন্দা সুভাষ সাঁতরা বলেন,
’জগন্নাথ আমাদের গ্রামের ছাত্র ছাত্রীদের কাছে প্রেরণা। তাই মাধ্যমিক পরীক্ষার কটা দিন ওকে
পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া ও নিয়ে আসার দায়িত্ব তিনিই নিয়েছেন বলে জানান’। পরীক্ষাকেন্দ্র বাগিলা পূর্ণচন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা অনন্যা তরফদার জানিয়েছেন,’পা দিয়ে জগন্নাথ এত সুন্দর করে লিখছে, যা দেখে প্রত্যেকের ভাল লাগছে।পায় দিয়ে লেখাও যে এত সুন্দর হয় এবং কেউ পা দিয়ে উত্তর পত্রে গুছিয়ে লিখতে পারে সেটা জগন্নাথকে দেখেই তারা জানলেন।প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এই ছাত্র যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে,সেটা দেখে অন্যা পড়ুয়ারাও অনুপ্রাণিত হবে’।
ছাত্র জগন্নাথ জানিয়েছে,’এখনও পর্যন্ত তার সব পরীক্ষাই ভাল হয়েছে।পরীক্ষার জন্য প্রতিদিন সে ৪-৫ ঘন্টা পড়াশোনা করেছে। তাঁর একজন মাত্র প্রাইভেট টিউটর ছিল ঠিকই, কিন্তু স্কুলের শিক্ষকরাই তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে।কষ্ট যাই হোক আগামী দিনেও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায় জগন্নাথ ।সে জানিয়েছে,তার স্বপ্ন একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়া। শিক্ষক হয়েই সে তার মত যারা আছে তাদের পাশে দাঁড়াতে চায় বলে জগন্নাথ মন্তব্য করেছে’।জগন্নাথের ঠাকুমা মুঙ্গলী মাণ্ডি ও পিস রিবি মুর্মু বলেন, ’জগন্নাথ লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে প্রতিষ্ঠিত হোক ,মানুষের মত মানুষ হোক এটাই আমরা চাই ।ওর মা ওকে ছেড়ে চলে গেলেও আমরা আগামী দিনেও ওর পাশে থাকবো ।জগন্নাথ একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠলে আমাদের আদিবাসী মহল্লার ছেলে মেয়েরাও লেখাপড়া শেখায় অনুপ্রাণিত হবে’।।