এইদিন ওয়েবডেস্ক, তেল আবিব,১৩ এপ্রিল : ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামাসকে নির্মুল করতে গাজাকে মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ইসরায়েল ! আর এই আশঙ্কার পিছনে রয়েছে বিগত মাসগুলিতে গাজায় ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের ভয়ংকর অভিয়ান ।
১ এপ্রিল ২০২৫। গাজা উপত্যকার খান ইউনিস ও রাফাহর মধ্যকার অঞ্চলের ‘মোরাগ’ করিডোর নিয়ন্ত্রণে নিতে অভিযানে নামে ইসরায়েল বাহিনী। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য ছিল, তাদের সেনারা নিরাপদ অবস্থানে না যাওয়া পর্যন্ত যেন এই অভিযানের খবর সামনে না আসে। তবে দেশটির রাজনীতিবিদরা তা হতে দেননি। ওই দিনই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ জানান, ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সন্ত্রাসীদের এলাকা ধ্বংস ও পরিষ্কার করার জন্য একটি নতুন অভিযান শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, এর লক্ষ্য ছিল গাজার বিস্তৃত অঞ্চল দখল করা এবং সেগুলোকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা অঞ্চলে যুক্ত করা।
এর কয়েক ঘণ্টা পরে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি গর্ব করে বলেন, ইসরায়েল গতিপথ পরিবর্তন করছে। জেনারেলদের আশঙ্কার মধ্যেই তিনি অভিযানের নাম ও অবস্থানও প্রকাশ করেন। এই অভিযানের নাম ছিল মোরাগ রুট। মোরাগ ছিল একটি ছোট ইসরায়েলি বসতি, যা রাফাহ এবং খান ইউনিসের মধ্যে অবস্থিত ছিল। এখন ইসরায়েলি সেনারা আবার সেখানে ফিরে এসেছে। তাদের লক্ষ্য হল ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটারের উপকূলীয় অঞ্চল গাজাকে পৃথক করা এবং সেখানকার শাসক ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা। এরইমধ্যে রাফাহর দখলে নিয়েছে ইসরায়েল। গাজায় হামলা আরও জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ। রাফাহর বাসিন্দাদের উপকূলের সংকীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা দ্য ইকোনমিস্টকে নিশ্চিত করেছেন যে, গাজার দক্ষিণে রাফাহ অঞ্চলটি স্থায়ীভাবে খালি করার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। গাজার ২০ শতাংশ মানুষ এই অঞ্চলটিতে বাস করে। এই পদক্ষেপগুলো ২০ লাখের বেশি গাজাবাসীকে উপকূলবর্তী অঞ্চলে বসবাসে বাধ্য করার একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। বিশ্লেষকদের মতে, আপাতদৃষ্টিতে ইসরায়েল হামাস নিশ্চিহ্ন করার কথা বললেও তারা চাইছে যাতে গাজাবাসীরা স্বেচ্ছায় ভূখণ্ডটি ত্যাগ করে।
এক মাস আগে গাজায় সাহায্য বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। তাদের দাবি, উপত্যকাটিতে প্রচুর পরিমাণে খাবার রয়েছে এবং হামাস এটি নিয়ন্ত্রণ করে। গাজার বেসামরিক নাগরিকরা উপকূলে আশ্রয় নিলে ইসরায়েলি সেনারা হামাসকে পাশ কাটিয়ে খাবার সরবরাহের জন্য মোরাগ পথ ব্যবহার করতে চায়।বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ইসরায়েলি নীতির একটি বড় পরিবর্তন । সাম্প্রতিক সময়ে আইডিএফ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে গাজায় মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছিল। ব্যক্তিগতভাবে জেনারেলরা বলেছিলেন, তারা গাজায় কার্যত পুনরায় দখল এড়াতে চান। এখন রাজনীতিবিদদের চাপে তারা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন পরিকল্পনার অধীনে আইডিএফ উপকূলে আশ্রয় নেওয়া বেসামরিক নাগরিকদের সরাসরি সরবরাহ বিতরণ করবে। গাজার বাকি অংশে তারা হামাসকে শেষ পর্যন্ত নির্মূল করার আগে সহায়তা দেবে না।
এই সহায়তা দেওয়া কখন শুরু হবে তা স্পষ্ট নয়। এদিকে আবার গাজায় খাদ্য সরবরাহের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি গাজায় রুটি উৎপাদনকারী ২৫টি বেকারি বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ সংস্থাটি তাদের আর জ্বালানি বা ময়দা সরবরাহ করতে পারে না। গাজার পরিবারগুলো তাদের নিজস্ব খাদ্য তৈরি করতে পারছে না। কারণ সেখানে যুদ্ধের মধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং চিনি এবং রান্নার তেলের মতো প্রধান পণ্যগুলো বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া ভূখণ্ডটিতে পানির অভাবও তীব্র। জাতিসংঘের মতে, বেশিরভাগ গাজার দিনে মাত্র ছয় লিটার পরিষ্কার পানি পাওয়া যায়। এই অভাবই গাজার বাসিন্দাদের জীবনের জন্য একমাত্র হুমকি নয়। গত মাসে ইসরায়েলি সেনারা রাফাহর কাছে ১৫ জন ফিলিস্তিনি চিকিৎসককে হত্যা করে। আইডিএফের দাবি ছিল, চিকিৎসকদের বহরটি আলো বা সাইরেন ছাড়াই সন্দেহজনকভাবে গাড়ি চালাচ্ছিল।
নিউইয়র্ক টাইমসের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এই বিবৃতি ভুয়া ছিল। সেই অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে আলো এবং জরুরি সংকেত চালু ছিল। ইউনিফর্ম পরা চিকিৎসকদের বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। এসব ঘটনা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের বিরল বিক্ষোভকে উস্কে দিয়েছে। ইসরায়েল প্রথমে ১৮ ই মার্চ বিমান হামলা এবং তারপর স্থল অভিযানের মাধ্যমে গাজায় দুই মাস ধরে চলা যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে। তারপর থেকে এটি এক হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। আরও বিক্ষোভের আশঙ্কায় হামাস ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী আরেকটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে প্রস্তুত।
হামাস বলছে, ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে তারা ৫৯ জন ইসরায়েলি পনবন্দিকে (তাদের বেশিরভাগই মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়েছে) ছেড়ে দেবে কিন্তু এরপরেও ইসরায়েল আবার যুদ্ধ শুরু করতে চায়।বিশ্লেষকদের মতে, এমন অবস্থায় গাজার দৃশ্যপট অন্ধকার। গাজা যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট একজন কূটনীতিক বলেন, গাজায় যুদ্ধের পরের ঘটনা কোনো পরিকল্পনা নিয়ে এখন গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে না। তবে এরমধ্যেও ফিলিস্তিনিদের কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে গত ৭ এপ্রিলের ঘটনা। ওই দিন আমেরিকায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর মধ্যে এক বৈঠক হয়। যেখানে বলেন, ‘আমি যুদ্ধ (গাজায়) বন্ধ দেখতে চাই। আমি মনে করি যুদ্ধ এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যাবে, যা খুব দূরের ভবিষ্যতে হবে না।’।

