জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,০৯ আগস্ট : নিজের কার্যকালের সময় বোফোর্স দূর্নীতিতে নাম জড়িয়েছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্বর্গীয় রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে ৷ তখন বামপন্থীরা দেশ জুড়ে প্রচার চালিয়েছিলেন “গলি গলি মে শোর হ্যায়/রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়” । পশ্চিমবঙ্গের দেওয়ালে দেওয়ালে এবং স্লোগানে আকাশ-বাতাস ভরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই শ্লোগান । এখন আবার শুরু হয়েছে সেই ট্রেন্ড । গত বিধানসভা ভোটের পর শুভেন্দুকে দেখলেই তৃণমূলের ক্যাডাররা ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করছিল । শিক্ষক নিয়োগ দূর্নীতি মামলায় জেলবন্দি রাজ্যের প্রভাবশালী প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জ্জীকে দেখে ‘চোর’ বলে সম্বোধন করেছে কয়েদিরা । হাসপাতালে রুটিন মাফিক শারীরিক পরীক্ষা করাতে গিয়ে রুগীর আত্মীয়দের একাংশকে দেখা গেছে অনুব্রত মণ্ডলকে দেখে ‘গরু চোর’ বলে স্লোগান দিতে । অথচ কয়েকদিন আগেও অনুব্রতের বিরুদ্ধে কথা বলা ছিল কার্যত অসম্ভব । ‘নিলামে উঠেছে দলীয় পদ’ – টাকার বিনিময়ে দলীয় পদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ভগবানগোলার তৃণমূল বিধায়ক ইদ্রিস আলির বিরুদ্ধে এবং তার বাড়ি ভাঙচুর পর্যন্ত করা হয়েছে। চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নেওয়ার অভিযোগে হেনস্থা হতে হয় তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতার পরিবারের সদস্যদের।
রাজীব গান্ধী বা শুভেন্দুর বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে রাজনৈতিক দলের সদস্যরা। পার্থ বা অনুব্রতের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে সাধারণ মানুষ। তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকজন থাকতেই পারে। এই মুহূর্তে রাজীব গান্ধীকে নিয়ে আলোচনা করা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। বাকি তিন জনের বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়াই শুধু সন্দেহ ও অনুমানের ভিত্তিতে অভিযোগ করা হয়েছে এবং বিরোধী দলগুলো এটা করেই থাকে।
সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো ইদ্রিস আলির বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং অভিযোগটা করেছে নিজেরই দলের সদস্যরা। টাকার বিনিময়ে দলীয় পদ – কানাঘুষায় এই অভিযোগটা প্রায়শই শোনা যেত। যারা বেশি টাকা দিতে পারবে তারাই নাকি দলের বিভিন্ন পদ পাবে। ২০১৬ সালেও যারা সিপিএমের সামনের সারিতে ছিল অনেক জায়গায় আজ তারা তৃণমূলের সামনের সারিতে। বঞ্চিত হলো কারা ? যে সমস্ত তৃণমূল কর্মীরা এক সময় সিপিএমের ওই নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনীতির ময়দানে লড়াই করেছিল, তাঁরা । পুরনো দলে থাকা সত্ত্বেও ২০১১ থেকে ২০১৬ এর মধ্যে হয়ে যাওয়া কোনো নির্বাচনেই এরা সিপিএমকে জেতাতে পারেনি, উল্টে দলের ভোট কমেছে । তাহলে কোন অঙ্কে তাদের তৃণমূলের সামনের সারিতে আনা হলো ? কোন যাদুবলে ঘটনাটা ঘটল? এতদিন যে অভিযোগটা ফিসফাস আকারে হচ্ছিল এবার কিন্তু তাতে হাল্কা হাওয়া লেগেছে । গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না। তারপর যে ঝড় উঠবে সেটা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ ঝড়টা দলের অভ্যন্তর থেকে আসছে।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে নব্য তোলামূলী তৃণমূলীদের দাপটে তৃণমূল অন্ত প্রাণ এবং প্রথম থেকে দলের সঙ্গে যুক্ত তৃণমূলীরা পেছনের সারিতে চলে গেলো। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ভেবেছিল পঞ্চায়েত ভোটের মত সহজেই ৪২ এ ৪২ হবে। মাথায় ছিলনা লোকসভা ভোটটা কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে হবে। ফল বের হওয়ার পর দেখা গেলো তোলামূলীরা সামনে নাই। বিজেপি কর্মীদের দাপটের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করছে দলের সেই দুর্দিনের কর্মীরাই । ভাবা হয়েছিল এবার হয়তো দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সচেতন হবে। নেত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দলের দুর্দিনের কর্মীরা সামনে থাকবে। বাস্তবে উল্টো দেখা গেলো। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই স্থানীয় নেতৃত্বের প্রশ্রয়ে তোলাবাজরা সামনেই থেকে গেলো। গত বিধানসভা ভোটের সময় তোলাবাজরা আবার দেওয়ালে উঠে পড়েছিল। ভোটের ফল বের হওয়ার পর বিভিন্ন অশান্তিতে তাদের নাম সামনে আসে। তখনও দল কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এবার কিন্তু দলের ভিতর থেকেই প্রতিবাদ আসছে। প্রতিবাদটা তীব্র আকার ধারণ করার আগেই অসৎদের সরিয়ে সৎদের যদি সামনে আনা না হয় তাহলে কিন্তু বিপদ অনিবার্য। হয়তো তৃণমূল নেত্রী বিপদটা আঁচ করেছেন। তাই মন্ত্রী সভার পরিবর্তনের সময় তাকে যথেষ্ট বিষণ্ন লেগেছে। হতে পারে সেটা দীর্ঘদিনের সঙ্গী পার্থ চ্যাটার্জ্জীকে মন্ত্রীসভা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য অথবা আর এক ‘ভাই’য়ের আসন্ন সম্ভাব্য বিদায়ের আশঙ্কাজনিত কারণ।
ইতিমধ্যে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রধান, উপপ্রধান সহ দলের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দলের একাংশ ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেছে, সেই খবর পাওয়া যাচ্ছে। তার উপর আবার শোনা যাচ্ছে ব্লক সভাপতির পদ থেকে বহু জনকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে সেটা দেখার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা নিশ্চিতরূপে বলা যেত যদি বিরোধী দলে একজন মমতা ব্যানার্জ্জী থাকত তাহলে তৃণমূলের শেষের ইতিহাস লেখার কাজ শুরু হয়ে যেত। অথবা অভিষেকের ভাষায় হয়তো নতুন তৃণমূল দেখা যাবে ।।