ভারতে ‘ইমোশনাল ব্লাকমেলিং’-এর রাজনীতির শুরু সেই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সময় থেকে ৷ দেশ বিভাগের পর পাকিস্থানকে টাকা পাইয়ে দেওয়া হোক বা নিজের পছন্দমত কোনো মত চাপিয়ে দেওয়াই হোক, গান্ধী অনশনে বসে পড়তেন । এতে তিনি নিজের কাজ হাসিলও করতেন । দিল্লি বিধানসভার ভোটের আগে তিহার জেল থেকে বেরিয়ে গান্ধীর এই নীতিকেই কাজে লাগিয়েছিলেন মদ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত আম আদমি পার্টি সুপ্রিমো অরবিন্দ কেজরিওয়াল । তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়ে নিজেকে শুধু সৎ প্রমান করারই চেষ্টা করেননি, বরঞ্চ দিল্লিবাসীর সহানুভূতি কুড়োবার চেষ্টা করেছিলেন । যদিও তা কেজরিওয়ালের জন্য কাজে আসেনি । দিল্লিবাসী তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে ।
মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করার বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি গান্ধীর থেকে কোনো অংশে কম নন । সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কখনো তাকে পায়ে প্লাস্টার করে হুইল চেয়ারে বসে প্রচার করতে দেখা গেছে । কখনো ছোট্ট একটা দুর্ঘটনায় কপাল ছড়ে যাওয়ার পর কোনো অজ্ঞাত শত্রুর ‘হামলার তত্ত্ব’ খাড়া করে কপালে ব্যান্ড এড লাগিয়ে ভোটের প্রচার করেছেন। নিন্দুকদের দাবি, মমতার আসল উদ্দেশ্য হল মানুষের সহানুভূতি কুড়িয়ে ভোটে জেতা । তবে উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, প্রতি বারেই ভোটের ফলাফলে সাফল্যও পেয়েছেন তিনি ।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটের আর বিশেষ দেরি নেই । কয়েক মাস বা বড় জোড় এক বছর বাদেই ২০২৬ সালে রাজ্যের বিধানসভার ভোট হতে চলেছে । আর এই মুহুর্তে খুব একটা স্বস্তিতে নেই তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো । কারন সদ্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ২০১৬ সালের এসএসসির প্যানেল বাতিল হয়েছে । চাকরি হারিয়েছেন ২৬ হাজার যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থী । প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারনে প্রায় ১৯ হাজার যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে যাওয়ায় ক্ষোভে ফুৃঁসছে গোটা রাজ্য । কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে মমতা ব্যানার্জি ও অভিষেক ব্যানার্জিকে । বিজেপিও এই সুযোগ হাতছাড়া করছে না । দুর্নীতি ইস্যুতে মমতা ব্যানার্জিকে লাগাতার হামলা করে যাচ্ছে । এখন এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছেন মমতা । আর সহজ উপায় হল মানুষের সহানুভূতিকে কাজে লাগানো ! কিন্তু কিভাবে ?
রাজনৈতিক অভিজ্ঞমহলের মতে ২০২৬ এর ভোটের আগে মমতা নিজে গ্রেপ্তার হয়ে এই ‘টেকনিক’ কাজে লাগাতে পারেন । কিন্তু কি অভিযোগে ? এক্ষেত্রে ইস্যু হতে পারে সুপ্রিম কোর্টের ‘অবমাননা’ । আসলে, এসএসসির প্যানেল বাতিল হওয়ার পর থেকেই সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন মমতা ব্যানার্জি । যেদিন প্যানেল বাতিল হয় সেদিন নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি বলেছলেন,”আমি এই রায় মানিনা” । আজ সোমবার নেতাজি ইন্ডোরে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন মমতা ব্যানার্জি । পাশাপাশি তিনি এও বলেন যে এটা বলার জন্য যদি তাঁকে জেলেও পাঠানো হয় তিনি তাতে পরোয়া করেন না। আর এতেই সন্দেহ দানা বাধছে আদালত অবমাননার অভিযোগে তিনি জেলে ঢুকে দুর্নীতির এই ফাঁস কাটাতে চাইছেন!
আজ নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সদ্য চাকরিহারাদের মুখোমুখি হয়ে হয়ে আদপে কোনো আশার আলো দেখাতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী । উলটে তিনি চাকরিহারা শিক্ষকদের স্কুলে নিস্বার্থভাবে পড়ানোর পরামর্শ দেন । পাশাপাশি ‘পুরনো পেশায়’ ফিরে যাওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি । আজ ঠিক কি বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী ? তিনি বলেছেন, ‘আমি যোগ্যদের চাকরি যাক সেটা কখনও হতে দেব না। একটা কলমের খোঁচায় এতগুলো জীবন সমস্যায় পড়ে গিয়েছে। আর এটা করতে গিয়ে যদি আমাকে জেলেও ভরে দেয় তাহলেও আমি ডোন্ট কেয়ার। মানুষ যখন সমস্যায় পড়ে তখন তাদের পাশে দাঁড়াতে হয়। আমি কেস স্টাডি করে দেখেছি। যারা যোগ্য তারাও বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁদের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে।’ রাজ্য সরকার ফের সুপ্রিম কোর্টে যাবে এবং তার জন্য পাঁচজন আইনজীবীকে ঠিক করে ফেলা হয়েছে বলেও তিনি জানান ।
তিনি এও দাবি করেন,নিয়োগ দুর্নীতি তাঁর আড়ালেই হয়েছে৷ তিনি বলেন,’চাকরি বিক্রি হয়েছে, চাকরি চুরি হয়েছে আমি জানিই না। তাও আমাকে খারাপ কথা শুনতে হচ্ছে। কাজ করতে গেলে একটা দুটো ভুল হয়েই যায়। আমি কখনও যোগ্যদের চাকরি যাক সেটা হতে দেব না।’ যদিও মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি চাকরিহারা যোগ্য প্রার্থী থেকে শুরু করে বিজেপির কেউই বিশ্বাস করছে না । আজ শুভেন্দু অধিকারী বলেন,’মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পার্থ চ্যাটার্জিকে দিয়ে এসএসসির অটোনমি খতম করিয়েছেন । এসপি সিনহার নেতৃত্বে মন্ত্রীর ওএসডি ডাবলুবিসিএস অভিজিৎবাবুকে সিলেকশন কমিটিতে ঢুকিয়ে এসএসসির অটোনমি অনেক আগেই তিনি শেষ করে দিয়েছেন । অভিজিৎ গাঙ্গুলী যে প্রায় ৬০০০ প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন সেটা যদি মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিতেন তাহলে আজ এই ১৯০০০ প্রার্থীর এই অবস্থা হতো না ।’ শুভেন্দু অধিকারী স্পষ্ট বলেন, ‘এই ২৬ হাজার চাকরি বাতিল হওয়ার জন্য যদি কেউ দায়ী হয় তাহলে তিনি হলেন মমতা ব্যানার্জি ।’
শুভেন্দু অধিকারী বলেন,’সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার বেঞ্চ মিলে মোট ১৬ বার শুনানি হয়েছে । মমতা ব্যানার্জি কোটি কোটি টাকা খরচা করে আইনজীবী রেখে অযোগ্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করে গেছেন এবং যোগ্যদের বলি দিয়েছেন । এই ১৬ বারের একবারও যোগ্য অযোগ্য তালিকা পেশ করেনি।’ আজ নেতাজি ইন্ডোরে আবুল বাশার ও সুবোধ সরকারদের উপস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন করেন বিরোধী দলনেতা ।
যাইহোক, এসএসসির প্যানেল বাতিল মামলা সহজে ঠান্ডা বলে মনে হয় না । এখন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ মমতা ব্যানার্জি ২০২৬ সালের ভোটের আগে এই পরিস্থিতি থেকে কিভাবে নিজেকে বের করেন সেটাই দেখার বিষয় । তবে সুপ্রিম কোর্টের যোগ্য অযোগ্য তালিকা যে দেওয়া হবে না এটা স্পষ্ট । কারণ যোগ্যদের চিহ্নিত করলে অযোগ্যদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হবে মমতা ব্যানার্জি এবং এই দুর্নীতিতে যুক্ত তার দলের নেতা ও মন্ত্রীদের । সেই সাথে টাকা ফেরতের জন্য আন্দোলন শুরু হলে একদিকে যেমন তৃণমূলের দুর্নীতি ব্যাপক রূপে প্রকাশ্যে চলে আসবে হবে । পাশাপাশি অন্যদিকে বিপুল অংকের টাকা ফেরত দিতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হবে মমতা ব্যানার্জির দলকে ।।