এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,২২ ডিসেম্বর : ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তো আছেই, তার উপর রাজ্যের ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন(এস আই আর)-এ এক কোটির উপর ভুয়া ভোটারের নাম বাদ যাওয়ার আশঙ্কার পাশাপাশি মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের বহিষ্কৃত বিধায়ক হুমায়ুন কবিরের নতুন দল গঠন…. সবে মিলে মমতা ব্যানার্জির চতুর্থবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠছে । এক সময়ে প্রবল জনপ্রিয়তা থেকে সম্ভাব্য পরাজয়ের আশঙ্কার প্রভাব যেকোনো রাজনৈতিক নেতার শারিরী ভাষায় (body language) উপর পড়াটা স্বাভাবিক । মমতা ব্যানার্জির শারিরী ভাষাতেও কি সম্ভাব্য পরাজয়ের আশঙ্কার ছাপ ক্রমশ ফুটে উঠছে ? অন্তত বিজেপি নেতানেত্রীরা সেই কথাই মনে করছেন৷
আসলে,আজ সোমবার কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দলের বুথ লেভেল এজেন্টদের(বিএলএ) কর্মীসভা করেন মমতা ব্যানার্জি । আর বক্তব্যের মাঝে মাইক বিভ্রাট হলে তিনি চরম ক্ষিপ্ত হন । মাইক বিভ্রাটের জন্য তাকে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কাও প্রকাশ করতে দেখা যায়৷ মমতা ব্যানার্জি বলেন,’মাইক নেই । ভয়েস ক্লিয়ার কেন হয় না প্রতিদিন? এরা দেখছি ইন্ডোরে কাজ করছে না৷ এরা বারবার প্রবলেম ক্রিয়েট করছে । আমি আগের দিনেও দেখে গেছি,আজকেও দেখছি । দিস ইজ টু ব্যাড । এবার আমি কিন্তু একশন নেব, বলে দিলাম । আমি আগের দিনেও দেখে গেছি লোকের কমপ্লেন এসেছে । টাকা নিয়ে কাজ করেন আপনারা । সেটা আপনার প্রাপ্য । কিন্তু আপনারা সার্ভিসটা তো দেবেন । আর পুলিশ কি করে কেন দেখেনা ? যারা দায়িত্বে থাকে । আর পার্টির যারা থাকে তারা কেন সাউন্ড দেখেনা । আগে মাইক ঠিক হলে বলবেন শুনতে পাচ্ছেন কিনা । এটা সাবোটাজ আজ হচ্ছে না তো ? প্রত্যেকদিন এই মাইকের প্রবলেম কেন হচ্ছে ?’
এই বক্তব্যের সময় মমতার শারিরী ভাষায় “তাৎপর্য” খুঁজে পেয়েছেন রাজ্য বিজেপির যুবমোর্চার সহ-সভাপতি ও কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী তরুনজ্যোতি তিওয়ারি । ভিডিও ক্লিপটি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে তিনি লিখেছেন,’আজ তৃণমূলের BLA-দের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকের ভাষণটা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কথার চেয়ে বেশি স্পষ্ট ছিল তাঁর body language—আত্মবিশ্বাসের জায়গায় ছিল অস্থিরতা, দৃঢ়তার জায়গায় ছিল ভয়। এটা আর একজন আত্মবিশ্বাসী শাসকের ভাষণ নয়, এটা ছিল বিদায় টের পাওয়া একজন মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব।’
তার কথায়,’সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিতটা তিনি নিজেই দিয়েছেন। বক্তব্যের মাঝেই প্রশ্ন তুলেছেন— “sabotage হচ্ছে না তো?!”এই প্রশ্নই প্রমাণ করে, তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। নিজের দলের নেতাকর্মীদের উপর বিশ্বাস নেই, আর সবচেয়ে ভয়ের বিষয়—নিজের দলের আসল কর্মী, অর্থাৎ পুলিশ প্রশাসনের উপরও তাঁর আস্থা ভেঙে পড়েছে।’
তরুনজ্যোতি আরও লিখেছেন,যে ভয় আর যে ভূতের উপর ভর করে তিনি এতগুলো নির্বাচন পার করেছেন, সেই ভর আর কাজ করছে না। তাই আজ রাগ, সন্দেহ আর হুঁশিয়ারি—নেতৃত্ব নয়।তিনি বুঝতে পারছেন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মন বদলে গেছে। সাধারণ হিন্দুদের ক্ষোভ আর চাপা নেই। এমনকি তাঁর বহুদিনের তথাকথিত ৩৭% ভোটব্যাংক -এর মধ্যেও ফাটল ধরেছে—মুসলমান সমাজও বুঝে গেছে, তৃণমূল শুধু ব্যবহার করেছে, কিছু দেয়নি।এই সবকিছুর ফলেই আজ মুখ্যমন্ত্রী আতঙ্কিত। তিনি জানেন—সময় ফুরিয়ে আসছে।২০২৬ আর দূরে নয়।তৃণমূলের বিদায় আসন্ন—আর সেই সত্যটাই আজ তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভয় দেখাচ্ছে।’
প্রায় একই কথা মনে করছেন বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল৷ তিনিও এই বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন,’মাইক বিভ্রাট ? নাকি মনের বিভ্রাট বা ভয়? কি বলা যায় বলুন তো? আবার দিদি বলছেন ‘অন্তর্ঘাত’, আর পাবলিক বলছে— ‘স্যারের'(SIR) ভয়ে বোধহয় এখন মাইক্রোফোনও ঘামছে!আসলে ওপর মহলের চাপে যখন সব চুপ হয়ে যায়, তখন বেচারা মাইক আর একাই বা কী আওয়াজ করবে!তাই তো দিদির সন্দেহ—সাউন্ড সিস্টেমটা কি আদৌ তার সরকারের হাতে আছে তো? নাকি নির্বাচন আসার অনেক আগেই ওই ‘বিশেষ স্যারের’ রিমোট কন্ট্রোলে চলছে?’
প্রসঙ্গত,মমতা ব্যানার্জির “কোর ভোটব্যাংক” হল মুসলিম । কিন্তু ২০২৬ সালের আগে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বকারী একাধিক দলের আবির্ভাব ঘটে গেছে এরাজ্যে । বিহার বিধানসভায় ৫ আসনে উজ্জীবিত আসাউদ্দিন ওয়াইসি ইতিমধ্যেই মালদা জেলায় ঘাঁটি গেড়েছেন । পাশাপাশি মুর্শিদাবাদে উত্থান ঘটে গেছে বহিষ্কৃত তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবিরের নতুন দলের । আজ বেলডাঙ্গার জনসভায় নতুন দলের নাম ‘জনতা উন্নয়ন পার্টি’ নাম ঘোষণা করেছেন তিনি । হুমায়ুনের মঞ্চে দেখা গেছে তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ নেতা-নেত্রীদের। হুমায়ুন আগেই জানিয়েছিলেন যে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে একাধিক আসনে প্রার্থী দেবেন তিনি। সেই মতো একে একে নাম ঘোষণা করলেন আজ ।
ভরতপুর ও রেজিনগর- দুই কেন্দ্র থেকে নিজে লড়বেন হুমায়ুন। খড়্গপুর গ্ৰামীণ কেন্দ্রে ‘জনতা উন্নয়ন পার্টি’র প্রার্থী হবেন ইব্রা হাজি।মালদহের বৈষ্ণবনগরের প্রার্থী মুস্তারা বিবি।মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের প্রার্থী মনীষা পাণ্ডে।ভগবানগোলায় লড়বেন আর এক হুমায়ুন কবীর। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী।রানিনগর থেকে যিনি লড়বেন, তাঁর নামও হুমায়ুন কবীর।দক্ষিণ দিনাজপুরের ধনিরাম বিধানসভার প্রার্থীর নাম ডঃ ওয়েদুল রহমান।বালিগঞ্জের প্রার্থীর নাম নিশা চট্টোপাধ্যায়।ইছাপুরের প্রার্থীর নাম সিরাজুল মন্ডল। অর্থাৎ শুধু মালদহ-মুর্শিদাবাদে সীমাবদ্ধ থাকছেন না হুমায়ুন। বালিগঞ্জ, ইছাপুরের মতো কেন্দ্রের প্রার্থীর নামও ঘোষণা করা হয়েছে। শীঘ্রই ইস্তেহার প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সেই সাথে তিনি হুঙ্কার দিয়েছেন, মুর্শিদাবাদে তৃণমূলকে খাতা খুলতে দেবেন না। জেলার সবকটি আসনে তিনি প্রার্থী দেবেন বলেও জানিয়েছেন ।
পাশাপাশি আরও একটি ইসলামি দল রয়েছে। আর সেটা নওসাদ সিদ্দিকির আইএসএফ। এবারের বিধানসভার ভোটে হুমায়ূন-আসাদুদ্দিন ও নওসাদ সিদ্দিকি জোট করে লড়ার সম্ভাবনা রয়েছে । যা মমতা ব্যানার্জির রক্তচাপকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে । যার সরাসরি প্রভাব মমতার শারিরী ভাষায় দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিজেপির নেতানেত্রীরা ।।

