শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরীর অস্তিত্ব মিলেছে আরব সাগরের মুখোমুখি কচ্ছ উপসাগরের অতল গভীরে । মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের অস্তিত্বও রয়েছে হরিয়ানায়। পান্ডব-কৌরবদের পূর্বপুরুষ রাজা কুরু এই জায়গাটির পত্তন করেন। এই জায়গাতেই মহাভারতের ধর্মযুদ্ধ হয়েছিল বলা হয় । এছাড়া হিমালয়ের এমন অনেক গুহা আছে যেগুলি পঞ্চ পান্ডবরা অজ্ঞাতবাসের সময় ব্যবহার করেছিলেন বলে দাবি করা হয় । কিন্তু এত কিছু প্রমান থাকা সত্ত্বেও ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা শ্রীকৃষ্ণকে একটি কাল্পনিক চরিত্র এবং মহাভারতকে নিছক একটা মহাকাব্য হিসাবে অবিহিত করে । কিন্তু বাস্তবিক শ্রীকৃষ্ণ ও মহাভারত কি কাল্পনিক ? তবে ভারতের কথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিরা যাই বলুক না কেন শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু এবং মহাভারতের যুদ্ধের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক প্রমাণ তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অনিক কুমার সাহা । এই বিষয়ে তাঁর লেখা একটা প্রতিবেদন তুলে ধরা হল :
মহাভারতের কাহিনী অনেক প্রাচীণ কাল থেকে আমাদের এই উপমহাদেশের সাহিত্য, ধর্ম, সমাজ এমনকি আমাদের কথায়ও নানা রসদের জোগান দিয়ে আসছে। এই মহাভারতের যুদ্ধ কি আদৌও হয়েছিল কোনোদিন নাকি এটা একটা গল্প মাত্র এই ধরনের চিন্তা ভাবনা অনেকের মনেই প্রশ্ন তোলে৷ আমারও তুলেছিল। আমার মনে যে প্রশ্ন এসেছিল সেটা হলো শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তিথি আমরা পালন করি কিন্তু আসল জন্ম বা মৃত্যু তারিখ কবে ? আমি আবার জ্যোতির্বিজ্ঞাণের ভক্ত এবং তার মধ্যে একটি নতুন শাখা হলো প্রত্নতাত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞা ন(Archeoastronomy)। সেই শাখার কিছু আর্টিকেল নিয়ে পড়ার সময় একদিন হঠাৎ একটা আর্টিকেল আমার সামনে চলে আসে ডঃ এস বালাকৃষ্ণার লেখা । তিনি তার আর্টিকেলে জ্যোতির্বিজ্ঞান ব্যবহার করে মহাভারতের সময় নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। তার লেখা পড়ার পর আমি আরও বিস্তারিত পড়াশোনা করেছি অনেকদিন ধরে। অনেক আর্টিকেল,ইউটিউবের ভিডিও দেখা, ২টা গোটা বই পড়া , তাছাড়া আমার মার কাছে থাকা বিশাল মহাভারত পড়া এবং আমার কাছে থাকা রাজশেখর বসুর মহাভারতের সারানুবাদ এগুলো সব পড়তে হয়েছে।
মূল লেখা শুরুর আগে বলি লেখাটা আমার নিজের। কোথাও থেকে কপি করি নাই। ভাষাগত সমস্যা হতে পারে কারণ আমি যাই পড়েছি সব ইংরেজিতে পড়তে হয়েছে বাংলায় কোথাও কিছু পাইনি। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে লিখি না তবে এই লেখা আমার পরিচিতদের জন্য এবং এক বান্ধবীর রিকোয়েস্টে লেখা। আর লেখাটা পড়তে মহাভারতের মূলকাহিনী সম্পর্কে একটু ধারণা থাকতে হবে। জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও হবে আমি সহজ করে লিখবো। এখন মূল কথায় আসি :
প্রথমে আসি শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর তারিখের বিষয়টি নিয়ে:
হিন্দুধর্মের যুগ হলো চারটি যথা: সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি । আর মহাভারতের সময়টা ছিলো দ্বাপরযুগের শেষ আর কলিযুগের একদম শুরুর দিকে। ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ প্রাচীনভারতের একটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই। এই অতি প্রাচীন বইয়ের মতে, কলিযুগের শুরু হবে তখন যখন আকাশের ৭ টি গ্রহ মিনরাশিতে অবস্থান করবে। একটু বলে রাখি প্রাচীনভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আকাশকে পর্যবেক্ষণের জন্য ১২টি রাশিতে ভাগ করেছিলেন এই ১২ টি রাশির একটি হচ্ছে মিনরাশি(Pisces)। প্রাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা এটা মানতে রাজি ছিলেন না৷ কারণ তাদের মতে একরাশিতে সব গ্রহ এভাবে আশা সম্ভব না। কিন্তু আমি যার লেখা থেকে বিষয়টা উল্লেখ করলাম Dr. Ramesh panchwagh তিনি একটি প্ল্যানেটারিয়াম সফটওয়্যার ব্যবহার করে দেখতে পান আসলে এমন একটা দিন সত্যি হয়েছিল। প্ল্যানেটারিয়াম সফটওয়্যার হলো আকাশে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান কোথায় হবে সে সম্পর্কে ধারণা দেয়। এটা কেপলারের সূত্র ব্যবহার করে ভবিষ্যতে গ্রহ কোথায় থাকবে বা অতীতে কোথায় ছিলো তা বলে দিতে পারে। Ramesh panchwagh যে সফটওয়্যার ব্যবহার করেছিল তা হলো JPL(Jet Propulsion Laboratory) এর তৈরী করা সাইবার স্কাই প্ল্যানেটারিয়াম সফটওয়্যার। ওই সফটওয়্যারে দেখা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারীতে ৭ টি গ্রহ মীনরাশি। এধরনের ঘটনা আর ঘটেনি এখন। তাহলে বোঝা যায় এই সময়কালটা ছিলো মহাভারতের সময় কাল। এখন মৎস্যপুরাণ ও হিন্দু পন্ডিতদের মতে কলিযুগের শুরু হয় শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু থেকে অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় ওটাই শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুতারিখ।
মহাভারতের যুদ্ধের তারিখ নির্ণয় :
মহাভারত যারা পড়েছেন তারা সবাই জানেন মহাভারতে একটা যুদ্ধ হয়েছিল যা ১৮ দিন স্থায়ী ছিলো। ১৮ দিন চলা এ যুদ্ধে পান্ডব ও কৌরবদের মধ্যে পান্ডবদের জয় হয়৷ এখন প্রশ্ন হলো যুদ্ধটা হয় কখন? এটার তারিখ বা সময় বের করা খুবই জটিল ব্যাপার কিন্তু এর উত্তর আছে আকাশে ৷ আমরা সবাই মহাভারত পড়লেও মনোযোগ দিয়ে পড়িনি। মহাভারতে অনেক প্রায় দুশোর কাছাকাছি আকাশ পর্যবেক্ষণের উল্লেখ আছে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে মহাভারতের তারিখ বের করা যায়। এটার বিস্তারিত লিখতে গেলে অনেক বড় হয় লেখা তাই ছোট করে লিখছি। মহাভারতে মোট তিনটি সূর্যগ্রহণের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ আমি নিজে পড়ে যাচাই করেছি। যে পর্যবেক্ষণগুলোর উপর ভর করে তারিখ বের করা যায় সেগুলো আগে দিয়ে নেই। প্রথম সূর্যগ্রহণের বর্ণনা পাওয়া যায় সভাপর্বের একদম শেষে,যখন যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের কাছে পাশা খেলায় রাজ্য হেরে বনবাসে যাত্রা শুরু করে তখন ধৃতরাষ্ট্র আর বিদুরের কথায় একটা সূর্যগ্রহণের উল্লেখ আছে। বিদুর যুধিষ্ঠিরের রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ায় যে অমঙ্গল হচ্ছে তা বুঝাতে ধৃতরাষ্ট্রকে প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার উল্লেখ করেন। তার মধ্যে একটি লাইন হলো কাশীরাম দাস তার বাংলা করা মহাভারতে যে অনুবাদ করেছেন তা হলো, “সহসা গ্রাসিল রাহু দেব দিবাকর”। যেখানে স্পষ্ট সূর্যগ্রহণের উল্লেখ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় সূর্যগ্রহণের উল্লেখ আছে ভীষ্মপর্বে মহাভারতের যুদ্ধের শুরুর প্রথন দিন যখন মহাভারত রচয়িতা ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন, তোমার বংশের নাশ হবেই কারণ দিবসে তারা দেখা যাচ্ছে। দিবসে তারা একমাত্র সূর্যগ্রহণেই দেখা যায়। তৃতীয় সূর্যগ্রহণের উল্লেখ পাওয়া যায় কৃষ্ণের দ্বারকা নগরী ধ্বংসের দিন। তখনকার দিনে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ এগুলোকে অলক্ষুণে হিসেবে দেখা হতো৷ এই সূর্যগ্রহণ তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় নির্ণয়ের জন্য। এখন আসি আরো গুরুত্বপূর্ণ দুটো ঘটনার দিকে । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে উদ্যোগপর্বে শ্রীকৃষ্ণ হস্তিনাপুর গিয়েছিল দুর্যোধনের কাছে শান্তির বার্তা নিয়ে। যে রাতে কৃষ্ণ দ্বারকা থেকে যাত্রা করে সে রাতে চন্দ্রগহণ হয়েছিল। আর শান্তি চেষ্টা বিফল হলে ফেরত আসার সময় কৃষ্ণ কর্ণের সাথে কথা বলেন। তখন কর্ণ যুদ্ধের ভয়াবহতার অলক্ষুণে লক্ষণ হিসেবে আকাশে একটি ধুমকেতুর উল্লেখ করেন কারণ তখন ধুমকেতুকে অলক্ষুণে বলা হতো। এই একই ধুমকেতুর কথা ব্যাসদেবও ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের দিন বলেছিলেন।
এখন এই আকাশের সবগুলো পর্যবেক্ষণকে একত্রে মিলিয়ে এর বয়স বের করা যায়। প্রথম সূর্যগ্রহণ যখন হয় তখন যুধিষ্ঠির বনবাস যাত্রা করেন । তাঁরা বনবাসে ছিলেন মোট ১৩ বছর আর তার একবছর পর ঠিক ১৫ বছরের মাথায় হয় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ যখন আর একটা সূর্যগ্রহণের উল্লেখ আছে। গান্ধারীর অভিশাপ অনুযায়ী যুদ্ধ শেষ হবার ৩৬ বছর পর দ্বারকার পতন হয় যখন তৃতীয় সূর্যগ্রহণ হয়। তার মানে ৫০ বছরের মধ্যে পরপর তিনটি সূর্যগ্রহণ হয়। এখন আসি দ্বিতীয় সূর্যগ্রহণ মানে যুদ্ধের দিনের ঘটনায়। আগেই বলেছি যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ শান্তির বার্তা নিয়ে যাওয়ার সময় চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল তার ঠিক ১৩ দিন পর যুদ্ধ শুরু হয় তার মানে চন্দ্র গ্রহণের ১৩ দিন পর সূর্যগ্রহণ হয়। আর আকাশে একটা ধুমকেতুর উল্লেখ করা হয়েছ যা ১৩ দিন ধরেই ছিলো আর এতো দিন আকাশে শুধু হ্যালির ধুমকেতু থাকে তাই সেটাও হ্যালির ধুমকেতু ধরে নেওয়া যায় । হ্যালির ধুমকেতু ৭৬ বছর পরপর আসে এখন এমন কোন বছর যখন হ্যালির ধুমকেতু ছিলো এবং সাথে চন্দ্রগ্রহণ আর তার ঠিক ১৩ দিন পর সূর্যগ্রহণও হয়। প্ল্যানেটারিয়াম সফটওয়্যার ব্যবহার করে দেখা যায় তা হলো খ্রিষ্টপূর্ব ৩১২৬ সন। এটাই হলো মহাভারতের যুদ্ধের সন কারণ এর ঠিক ৫০ বছরের আগে পরে আরো দুটো সূর্যগ্রহণ হয়েছে। আর ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে গ্রহের গতিবিধিরও উল্লেখ করেন সেগুলো লিখতে গেলে লেখা শেষ হবে না। সেগুলো থেকে যে তারিখ পাওয়া যায় তা হলো ৬ নভেম্বর অর্থাৎ ৬ নভেম্বর খ্রিষ্টপূর্ব ৩১২৬ সাল হলো যুদ্ধের প্রথম দিন।
এখন মহাভারতের মূল রচয়িতা আকাশে যা পর্যবেক্ষণ করেছন তাই লিখেছেন বানিয়ে লেখেননি। কারণ বানিয়ে লিখতে হলে তাকে কেপলারের সূত্র জানতে হতো যা তখন তার জানার কথা নয়। আর সফটওয়্যারের জন্য তাকে ইরোরয় আসতে হত । তারমানে মহাভারতের ঘটনাগুলো শুধুই গল্প না প্রাচীন ভারতের ইতিহাসও।
যেসকল বইয়ের সাহায্য নিয়েছি:
• কাশীরামদাসের মহাভারত
• রাজশেখর বসুর মহাভারত সারানুবাদ
• In the lost city of krishna – vanamali
• When did mahabharata war happen- Nilesh Nilkanth Oak ।।