নাম্বি নারায়ণন ছিলেন ভারতের সেই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী যিনি ইসরোকে মার্কিন গবেষণা সংস্থা নাসার সমকক্ষ করতে চেয়েছিলেন । নাম্বি নারায়ণন যখন ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন তৈরির চুড়ান্ত পর্যায়ে, সেই সময় কেরালার দুই দেশদ্রোহী মুসলিম মহিলাকে কাজে লাগিয়ে উলটে নাম্বি নারায়ণনকে দেশদ্রোহিতার মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেয় আমেরিকা । কিন্তু দেশের এতবড় এক প্রতিভাবান বিজ্ঞানীকে বাঁচানোর পরিবর্তে রহস্যজনক ভূমিকা অবলম্বন করে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার এবং কেরালার বামফ্রন্ট সরকার ।
নাম্বি নারায়ণন জন্মসূত্রে কেরালার বাসিন্দা । কিন্তু তিনি বসবাস করতেন তামিলনাড়ুতে । ইসরোর চেয়ারম্যান ছিলেন নাম্বি নারায়ণন ৷ সেই সময় ক্রায়োজেনিক প্রযুক্তির অভাবে ভারত মহাকাশে উপগ্রহ পাঠাতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল । ক্রায়োজেনিক প্রযুক্তি হল কম তাপমাত্রায় স্যাটেলাইট ইঞ্জিনের কাজ করার সাথে সম্পর্কিত প্রযুক্তি । ইসরো এই প্রযুক্তি দেওয়ার জন্য রাশিয়া, আমেরিকা এবং ফ্রান্সকে অনুরোধ করছিল । কিন্তু ভারতের কথিত শত্রু পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার অজুহাতে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে আমেরিকা । রাশিয়া তখন ততটা শক্তিশালী ছিল না । আমেরিকার হুমকির কারনে ফ্রান্সও ভারতকে ক্রায়োজেনিক প্রযুক্তি দেওয়া থেকে পিছিয়ে আসে ।
তখন নাম্বি নারায়ণন সিদ্ধান্ত নেন যে দেশীয় প্রযুক্তিতেই তৈরি করবেন ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন । এরপর দিনরাত এক করে তিনি নেমে পড়েন ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন তৈরির মিশনে । কিন্তু যখন সাফল্য প্রায় হাতের মুঠোয়,সেই সময় ইসরোর এই পরিকল্পনাকে বানচাল করতে একটা ষড়যন্ত্র করে আমেরিকা । কাজে লাগায় তাদের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-কে । সিআইএ ভারতে কয়েকজন দেশদ্রোহীকে টাকা দিয়ে কিনে নেয় । এরপর তাদের সাহায্য নাম্বি নারায়ণনকে রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা অভিযোগে জড়িয়ে জেলে পাঠায়।
এই ঘটনায় কেরালা পুলিশ দুই মুসলিম মহিলাকে গ্রেপ্তার করে যাদেরকে পাকিস্তানের গুপ্তচর বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল । তাদের মিথ্যা বয়ানকে স্বীকৃতি দিয়ে পুলিশ নাম্বি নারায়ণনকেও গ্রেপ্তার করে । ওই দুই মহিলা বলেছিল যে নাম্বি নারায়ণন তাদের ক্রায়োজেনিক প্রযুক্তির অঙ্কন দিয়েছিলেন এবং তারা সেই স্কেচগুলো পাকিস্তানকে দিয়ে দেয় ।
নাম্বি নারায়ণন নিজেকে নির্দোষ প্রমাম করার অনেক চেষ্টা করেন । কিন্তু কেরালা পুলিশ তার কোনো কথাতে কান দেয়নি । শুধু কেরালা পুলিশই নয়, না কেরালার কমিউনিস্ট সরকার, না ভারত সরকার, কেউই তার কথা শোনেনি । অনেকে অভিযোগ করে যে কেন্দ্র ও রাজ্যের হেভেওয়েট নেতা আমেরিকার এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল ।
মামলায় জড়ানোর সাথে সাথে তার ইসরো সহকর্মীরা এবং সমাজের একাংশও নাম্বি নারায়ণনকে কার্যত একঘরে করে দেয় । অটো চালকরা তার পরিবারকে অটোতে বসতে দেয়নি, মন্দিরের পুরোহিত তার পরিবারের সদস্যদের প্রসাদ দেয়নি । মানসিক চাপে এক সময় আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নাম্বি নারায়ণন । কিন্তু পরিবারের পীড়াপীড়িতে, তিনি বিশ্বাসঘাতক এবং বিশ্বাসঘাতক হওয়ার কলঙ্ক মুছে ফেলার জন্য মামলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । বহু বছর পরে কেন্দ্রে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে দায়রা আদালত, হাইকোর্ট থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত একে একে তাকে শুধু নির্দোষই নয়, সম্মানজনকভাবে খালাসও দিয়েছে।
কিন্তু ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর এই ২৫ বছরে ভারত এবং নাম্বি নারায়ণন কী হারিয়েছেন তার যন্ত্রণা একমাত্র নাম্বিই বুঝতে পারেন । যখন তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন, যা নিয়ে দেশের কোনও বুদ্ধিজীবী উদ্বেগ প্রকাশ করেননি, কোনও বিতর্ক হয়নি কোনো মিডিয়াতে, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা দুটি শব্দও বলেনি । নাম্বি নারায়ণন দেশের একজন মহান বিজ্ঞানী ছিলেন এবং ভারতকে এমন একটি প্রযুক্তি দিতে চলেছিলেন যা ভারতকে আমেরিকার সাথে প্রতিযোগিতা করতে প্রস্তুত হয়েছিল । কিন্তু তার গ্রেফতারিতদ এই সময়ে ভারত কেবল মহাকাশ বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়েনি বরঞ্চ বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় । নাম্বি নারায়ণন তাঁর আত্মজীবনীতে সেই ঘটনা ও বেদনার সমগ্র ক্রম বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন ।
এদিকে সুপ্রিম কোর্ট একটি কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে যে বলেছিল নাম্বি নারায়ণনকে জড়িত মামলায় পুলিশ আধিকারিকদের ভূমিকার তদন্ত সিবিআইকে দেওয়া হোক। আদালতের সেই নির্দেশের ভিত্তিতে সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) ১৯৯৪ সালের ইসরো গুপ্তচরবৃত্তির মামলায় মহাকাশ বিজ্ঞানী নাম্বি নারায়ণনকে অভিযুক্ত করার অভিযোগে দুই প্রাক্তন ডিজিপি, কেরালার সিবি ম্যাথিউস এবং গুজরাটের আরবি শ্রীকুমার এবং তিনজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে ২০২১ সালে একটি মামলা নথিভুক্ত করার তিন বছর পর, সিবিআই তৎকালীন পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল ম্যাথিউসের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে, যিনি এই মামলার বিশেষ তদন্তকারী দলের (এসআইটি) প্রধান ছিলেন । শ্রীকুমার, যিনি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন । এছাড়া পিএস জয়প্রকাশ তখন এসআইবি-কেরালায়, তৎকালীন ডেপুটি পুলিশ সুপার কে কে জোশুয়া এবং ইন্সপেক্টর এস বিজয়নের নাম রয়েছে ওই চার্জশিটে । সিবিআই তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির (আইপিসি) ১২০বি (অপরাধী ষড়যন্ত্র), ৩৪২ (মিথ্যা অভিযোগে আটকে রাখা), ৩৩০ ( স্বীকারোক্তি আদায় করতে আঘাত করা), ১৬৭ (মিথ্যা নথি তৈরি করা), ১৯৩ (প্রমাণ জালিয়াতি),৩৫৪(মহিলাদের উপর অপরাধমূলক হামলা) প্রভৃতি ধারায় অভিযুক্ত করেছে ।।