রক্ত কখনো বেইমানি করে না । এই চরম সত্যের জলন্ত উদাহরণ হল আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদশি নাগরিক পিনকি ভট্টাচার্য । কারন হিন্দু ব্রাহ্মণ পদবীধারী পিনাকির ভারত ও হিন্দু বিদ্বেষী মানসিকতা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই প্রশ্ন ওঠে । আমেরিকায় বসে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক ভারত ও হিন্দু বিদ্বেষী পোস্ট করে যায় । একারে তার আসল পিতৃ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে মাঝেমধ্যেই । কাগজে কলমে তার বাবা বাংলাদেশের বগুড়ার শ্যামল ভট্টাচার্য এবং মা সুক্রিতি ভট্টাচার্য হলেও পিনাকির আসল পিতৃ পরিচয় ভিন্ন । ‘ভট্টাচার্য’ পদবি হলেও পিনাকি আদপে একজন পাকিস্তানি রাজাকারের ‘জারজ সন্তান’ এবং ধর্ষণে জন্ম তার । আর এই সত্য প্রকাশ্যে আনেন আমানউল্লাহ খান নামে শ্যামল ভট্টাচার্যর একজন বন্ধু । তার সেই স্বীকারোক্তি ১৪১৯ বঙ্গাব্দের ২৮ শে শ্রাবণ প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের সংবাদপত্র দৈনিক ইত্তেফাক-এ । প্রতিবেদনটি নিচে তুলে ধরা হল :
কীর্তিমান পুরুষ শ্যামল ভট্টাচার্য দা ১৯৩৯ সালের ১০ আগস্ট বগুড়ার জলেশ্বরীতলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে বগুড়া জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি প্রকৌশল নিয়ে ডিপ্লোমা পাশ করেন ঢাকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। এর পরে প্রকৌশলী হিসাবে কিছুদিন সরকারি চাকরিও করেন। একজন শিক্ষক, নাট্যকার এবং মানুষের পথপ্রদর্শক আমার প্রিয় শ্যামল ভট্টাচার্য দা।
‘বগুড়ার বাতিঘর’ হিসেবে পরিচিত শ্যামল ভট্টাচার্য জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। শ্যামল ভট্টাচার্য বগুড়া জেলা স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে গেছেন সারা জীবন। শিক্ষকতা জীবন শেষ করেও, নিজের টাকায় বই বিতরণ করে শিক্ষা বিস্তারে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা।
বন্ধুবৎসল, অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী, মানবতাব অমায়িক মানুষ ছিলেন আমাদের শ্যামল দা। লেখক হিসাবেও তার ব্যাপক খ্যাতি, কিন্তু ব্যক্তি জীবনে ছিলেন অসুখী, তাই সর্বস্য বিলিয়ে যাচ্ছেন মানব কল্যানে । মৃত্যু পরবর্তী নিজের দেহও দান করে যেতে চান মেডিকেল কলেজে, যাতে মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা দেহের ব্যবচ্ছেদ করে শিখতে পারে। মানব কল্যাণের এমন চিন্তা ক’জন করে? শ্যামল দার জন্মদিন উপলক্ষ্যে, কিছু বিস্তৃত স্মৃতি লিখতে বসেছি।
১৯৬৫ সালে বগুড়ার এসডিইও হিসেবে জয়েন করেন পাকিস্তানের লাহোর নিবাসী সোয়েব আব্দুল্লাহ। ফর্সা, লম্বা চওড়া উঁচু গড়নের সুদর্শন এসডিইও সাহেব বগুড়া বাসীর কাছে খুবই প্রিয় ছিলেন। এসডিইও সাহেব ছিলেন সংস্কৃতি মনা। এসডিইও সাহেব বিভিন্ন স্কুলে পরিদর্শন করলে স্কুল কর্তৃপক্ষ আয়োজন করতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এসডিইও সাহেব নিজেও পারফর্ম করতেন, গান গাইতেন, আবৃত্তি করতেন। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে বগুড়া জেলা স্কুলের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আসেন এসডিইও সাহেব। দারুণ পারফর্মার তখনকার তরুণ নাট্য নির্দেশক শ্যামল ভট্টাচার্য দার সাথে এসডিইও সাহেবের পরিচয় হয় তখনই। বন্ধুবৎসল শ্যামল দার সাথে এসডিইও সাহেবের সম্পর্ক গড়ায় পারিবারিক পর্যায়ে। শ্যামল দার বাসায় প্রায়ই আসতেন এসডিইও সাহেব। আমিও যেতাম। সাংস্কৃতিক আলোচনায় জম্পেশ চায়ের আড্ডা দিতাম শ্যামল দার বাসায়। একদিন এসডিইও সাহেব শ্যামল দাকে বললেন, জাতি গঠনে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে । মানবপ্রেমী শ্যামলদা ও রাজি হলেন । এসডিইও সাহেব বগুড়া জেলা স্কুলে শ্যামল দার চাকুরীর ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। শ্যামলদা এসডিইও সাহেবের অনুরোধে সরকারি চাকরি ছেড়ে শিক্ষণ প্রশিক্ষণ কোর্স করতে ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় চলে যান ৬ মাসের প্রশিক্ষণে। মহাপ্রাণ এসডিইও সাহেব ভর্তি ও থাকার ব্যবস্থাও করে দেন। জুন মাসে সুক্রিতি বৌদির চিঠি মারফত জানতে পারেন শ্যামল দা বাবা হতে যাচ্ছেন। বৌদির চিঠি পেয়ে আনন্দের আর সীমা ধরে না শ্যামল দার, বগুড়া ফিরে আসার জন্য উনি উতলা হয়ে উঠেন। প্রিন্সিপাল এর কাছ থেকে ছুটির প্রার্থনা করেও ছুটি জুটলো না, সুক্রিতি বৌদিকে চিঠিতে জানালেন সেই কষ্টের কথা। প্রশিক্ষণ শেষে বগুড়া ফিরলেন আগষ্ট মাসে। ফেরার পরপরই শ্যামল দাকে এসডিইও সাহেব বগুড়া জেলা স্কুলের শিক্ষক হিসাবে জয়েন করার কথা বলেন। শ্যামল দা সুক্রিতি বৌদির শুশ্রূষার কথা চিন্তা করে সেই সময় যোগদান করেন নি, সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর যোগদান করবেন বলে এসডিইও সাহেবকে জানান।
এদিকে ১৯৬৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারী থেকে এসডিইও সাহেব কিশোরগঞ্জে বদলী হয়ে যাচ্ছেন জেনে অগত্যা জানুয়ারী মাসে সন্তান জন্মগ্রহণ না করা সত্যেও শিক্ষকতার চাকুরীতে যোগদান করেন ১৯৬৭ সালের ১৬ জানুয়ারি। ডিসেম্বর – জানুয়ারিতেও সুক্রিতি বৌদির সন্তান জন্মগ্রহণ না করাতে শ্যামল দার সন্ধেহের তীর বাকে আমার দিকে।
কথায় চাল চলনে তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। বুঝলেও না বুঝার ভাব ধরে থাকতাম। জানুয়ারী মাস থেকেই তার ব্যক্তি জীবনের অশান্তির শুরু। সন্দেহের দানা বড় হতে থাকে ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে, সুক্রিতি বৌদির সাথে প্রতিদিনই ঝগড়া ঝাটি হতো তখন। বৌদিকে পাঠিয়ে দেন বৌদির বাপের বাড়ি। ১৯৬৭ সালের মার্চের প্রথম দিনে সুক্রিতি বৌদির প্রথম পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। রাগে ক্ষোভে প্রথম সন্তানের মুখ পর্যন্ত দেখতে যাননি শান্ত সরল শ্যামল দা। পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে লোকলজ্জার ভয়ে ৩ মাস পরে, সুক্রিতি বৌদিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন।
আমরা সমবয়সী, শ্যামল দার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো, অনেক ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন আমাকে। দুঃখ সুখের সকল প্রানের কথাই আমাকে বলতে শ্যামলদা । কিন্তু দীর্ঘ এক বছর কথা বলেননি আমার সাথে। সংস্কৃতি প্রেমী এসডিইও সাহেবকে কতই না ভালো ছিলেন শ্যামল দার কাছে। সুক্রিতি বৌদি অনেক দিন পরে শ্যামুলদার কাছে স্বীকার করেছিলেন কিভাবে এসডিইও সাহেব বৌকে জোর পূর্বক ধর্ষণ করেছিলেন শ্যামল দার প্রশিক্ষণে যাওয়ার একমাসের মধ্যেই, লজ্জায় ভয়ে তখন শ্যামল দা কে জানাননি, অনেক চেষ্টা করেছেন এ সন্তান নষ্ট করতে কিন্তু সফল হননি। আমার প্রতি সন্দেহের তীরও কেটে যায় সুক্রিতি বৌদির শিশুসুলভ স্বীকারোক্তিতে। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচি, শ্যামল দার সাথে কথা বলা, বন্ধুত্ব আবারও শুরু হয়।
শ্যামল দার সেই ছেলে আজ ডাক্তার হয়েছে, লেখক হয়েছে, সাম্যবাদী হয়েছে। নিজের মতো করেই গড়ে তুলেছেন শ্যামল দা। নিজের ঔরসজাত সন্তান নয় এমনটা জেনেও শিশু পিনাকীকে একটুও কষ্ট দেননি, বুঝতে দেননি। এমন সাদা মনের মানুষ ক’জন আছে পৃথিবীতে ?
যদিও সেই ১৯৬৭ সাল থেকেই শ্যামল ভট্টাচার্য দাদা মানষিক অশান্তিতে ভুগেছেন, হয়তো ভুগবেন আমৃত্যু অবদি। আজকের দিনে সত্যিকারের মানুষ শ্যামল দা কে অগনিত সাদা গোলাপের শুভেচ্ছা।।
