জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,পূর্ব বর্ধমান,২৭ মার্চ :
“…… ঘুমের ঘোরে খুঁজি ফিরি আমি ফেলে আসা ছেলেবেলা”- যতই মরমী গায়িকা মনের মাধুরী মিশিয়ে তার দরদী কণ্ঠে ফেলে আসা ছেলেবেলার সুখ, দুঃখের কথা গানের সুরে ফুটিয়ে তুলুন না কেন ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের শিশুদের ছেলেবেলার আনন্দগুলো ভুলিয়ে দিচ্ছি। সম্পর্কগুলো হয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক। আনন্দগুলো হয়ে যাচ্ছে নকল হাসিতে মোড়া কৃত্রিম। জৈষ্ঠ্যি মাসে চুপিসারে আমের আচার চুরি করা, রাতের বেলায় মায়ের গানের সুরে চাঁদের যাতায়াত,পুকুর-মাঠে-কাশের বনে আজও মন খেলা করতে চাইলেও স্মার্টফোনের হাত ধরে সব কিছুই আজ স্মৃতির অন্তরালে । মায়ের বুকের দুধের পরিবর্তে বেবী ফুড খেয়ে বড় হওয়া আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে মা-বাবার স্নেহ থেকে এবং আত্মীয় স্বজনের সান্নিধ্য থেকে। কার্যত জন্মের পর থেকেই তাদের কাল্পনিক র্যাট রেসের মাঠে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে শৈশবের আনন্দটা কী সেটা তাদের কাছে অজানাই থেকে গেছে।
সকাল হতে না হতেই সোজা পায়ে হাঁটতে না-পারা শিশুর জন্য দরজার কাছে অপেক্ষা করছে স্কুল যাওয়ার জন্য ভ্যান। ঘুম ঘুম চোখে শিশু ওঠে স্কুলগামী ভ্যানে। অথচ সেই সময় তার থাকার কথা ঠাকুমার কোলে অথবা মায়ের আঁচলে নিরাপদ আশ্রয়ে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো হয়ে উঠছে স্ট্যাটাস সিম্বল। বাবা হলো ড্যাডি। আদরের পরিচিত ডাকগুলো সব অচেনা হয়ে গেল। আঙ্কল, আণ্টিতে ভরে গেল সমাজ। নিয়মের যাঁতাকলে আটকে শিশুরা হারিয়ে ফেলল শৈশবের আনন্দ। পরিণত হলো রোবটে ।
শিশুদের খেলার সাথী আজ শত্রু হয়ে গ্যাছে। দল বেঁধে লুকোচুরি খেলা, গায়ে ধুলো মাখা, পুতুল খেলা সহ সমস্ত শিশু সুলভ খেলা যেন আজ সুইস ব্যাংকের লকারে বন্দী হয়ে গ্যাছে। ডাংগুলি বা মার্বেল খেলার নাম তারা শোনেইনি। অথচ এই সব খেলাগুলো শুধু শিশুদের মনখোলা আনন্দ দ্যায়না, মুহূর্তের জন্য প্রবীণদেরও ফিরিয়ে দ্যায় তাদের শৈশবের আনন্দ। শিশু সুলভ আনন্দে তারাও মেতে ওঠে, নিজেদের বয়স ভুলে হাততালি দ্যায়। কিন্তু তথাকথিত আধুনিকতার চাপে আত্মকেন্দ্রিকতায় আক্রান্ত শিশু আজ সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে কারাগারের নির্জন কক্ষে বন্দী। বন্ধু কি বুঝতে না বুঝতেই কখন যে বড় হয়ে যায় জানতেই পারে না।
কলকাতার কয়েকটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কনসালটেণ্ট হিসাবে যুক্ত ক্লিনিকাল সাইকোলজির তানেয়া মুখার্জ্জী বললেন – বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবার মাঝে একজন শিশু বেড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর অবশ্যই তাকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে। কিন্তু অজ্ঞতার জন্য প্রথমেই আমরা তাদের সমাজ তথা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। শিশু এবং সমাজের ভবিষ্যতের পক্ষে দুটোই সমান ক্ষতিকর। শিশু হয়ে ওঠে আত্মকেন্দ্রিক। পরবর্তীকালে সবার সঙ্গে মেশার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলে ।
একই সুর শোনা গেল শোনা গেল আর এক কনসালটেণ্ট অরুণিতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে। তার বক্তব্য – একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত কড়া শাসনের পরিবর্তে খেলার ছলে শিশুদের নিয়মকানুন, পড়াশোনা শেখানো হোক। রবীন্দ্রনাথের আদর্শ অনুসরণ করে প্রকৃতির কোলে সবার মাঝে তারা বড় হোক। তবেই তো সত্যিকারের মানুষ হবে ।।