হিমাচল প্রদেশের জ্বালা দেবীর মন্দির হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম । হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকার দক্ষিণে ৩০ কিলোমিটার দূরে ৫১ শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম জ্বলাজি মন্দির রয়েছে । জ্বলা দেবী মন্দিরের নয়টি চিরন্তন শিখা জ্বলে। যেই শিখার উত্তাপ নিতে সারা ভারত থেকে হিন্দু পূণ্যার্থীরা এখানে আসেন । অনেকে এটিকে জাতাওয়ালি মায়ের মন্দির হিসেবেও চেনেন। হিমাচল প্রদেশের হিমালয় অঞ্চলের জ্বালা দেবীর মন্দির এক আশ্চর্য ধর্মীয় স্থান । এই পৌরাণিক শক্তিপীঠের সন্ধান পেয়েছিলেন পাণ্ডবরা । হিন্দুপুরাণ অনুযায়ী এই অংশে সতীর জিভ পড়েছিল। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে ৯টি অগ্নিকুণ্ড। কুণ্ডগুলি অন্নপূর্ণা, চণ্ডী, হিংলাজ, বিন্ধ্যবাসনী, মহালক্ষ্মী, সরস্বতী, অম্বিকা, অঞ্জিদেবী এবং মহাকালী নামে পরিচিত । তার আগুন কখনও নেভে না । শত শত বছর ধরে এই ৯ অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে । এই মন্দির নিয়ে রয়েছে নানা অলৌকিক ঘটনা ।
মোগল হানাদার আকবর বহু বার জ্বালা মন্দিরের ৯টি অনির্বাণ শিখা নেভানোর চেষ্টা করেছিল । কিন্তু তিনি প্রতিবারই ব্যর্থ হন। আগুনের উপর জল ঢেলে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি। তাতে কাজ না দেওয়ায় মন্দির সংলগ্ন খালের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েও আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন । সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয় । দেবীর এই অলৌকিক মহীমা দেখে টনক নড়ে হানাদার বাবরের । ভারতে ইসলামের প্রসার ঘটাতে আসা বাবরকে পর্যন্ত দেবীর উদ্দেশ্যে প্রণাম করতে হয়েছিল । দেবীকে একটি সোনার ছাতা অর্পণ করেন বাবর । তবে দেবী মাতা হানাদার বাবরের এই নৈবেদ্য গ্রহণ করেননি। বলা হয় সোনার ছাতাটি পড়ে গিয়ে সাধারণ ধাতুতে পরিণত হয়। সেই ধাতু কী তা আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি।
ব্রিটিশরাও জ্বালা মন্দিরের অনির্বান অগ্নিশিখার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি । স্বাধীনতার পর বিজ্ঞানীরা মন্দিরে আগুন জ্বলার রহস্য জানার অনেক চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা হতাশ হন। মনে করা হয় যে, ব্রিটিশরা মাটির নীচ থেকে নির্গত শিখা ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল । হিমাচল প্রদেশের জ্বালা দেবীর মন্দিরের মতোই জ্বালা দেবীর মন্দির রয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র আজারবাইজানে । সেখানেও অনাদিকাল ধরে জ্বলছে চিরন্তন অগ্নিশিখা । অনেকেই আজারবাইজানের এই পবিত্র হিন্দু মন্দির সম্পর্কে অবগত নয় । আসুন জেনে নেওয়া যাক আজারবাইজানের জ্বালা দেবীর মন্দির সম্পর্কে ।
আজারবাইজান হল পূর্ব ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত ইসলামিক দেশ। আজারবাইজান মানে “আগুনের দেশ” (Land Of Fires) । নব্বই শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার এই দেশটি আর্মেনিয়া, তুরস্ক, জর্জিয়া, রাশিয়া এবং ইরানের সাথে সীমানা ভাগ করে নিয়েছে। আতেশগাহ পারসি হিন্দু মন্দির আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর সুরখানি শহরে ৩০ একর জমিতে নির্মিত।
আতেশগাহ মানে জ্বালা দেবীর বাড়ি। আতেশগাহ দুটি ফার্সি শব্দের মিলন, আতেশ অর্থাৎ আগুন এবং গাহ অর্থে হোম নিয়ে গঠিত। আতেশ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘অথর্বণ’ থেকে এসেছে। আর্মেনিয়ান দার্শনিক এবং বহুবিষয়ক পণ্ডিত আনানিয়া সিরাকাতসি এই স্থানটিকে “সাতটি পূজার গর্ত সহ স্থান” (Place with seven worshiped holes) হিসাবে লিখেছেন। অষ্টম শতাব্দীর ঐতিহাসিক ঘেভন্ড ৭৩০ খ্রিস্টাব্দে এই স্থানটিকে অতশি-বাগুয়ান বলে লিখেছিলেন, যার অর্থ আগুনের প্রভু।
অতশি ফার্সি অতীশি থেকে উদ্ভূত এবং অতেশ অথর্বণ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ আগুন। বাগুয়ান ফার্সি শব্দ বাগ বা বগা থেকে এসেছে যার অর্থ ঈশ্বর এবং বগা এসেছে সংস্কৃত শব্দ ভাগ থেকে যার অর্থ ঈশ্বর। আজারবাইজানও অথরভান থেকে নেওয়া একটি ধার করা শব্দ। অথর্বণ ব্রহ্মার এক পুত্রের নাম, যিনি আগুন আবিষ্কার করেছিলেন।
পুরষ্যোসি বিশ্বম্ভরাঅথর্বা ত্যা প্রথমো নিরমন্থদগ্নে ।
ত্বামগ্নে পুষ্করদাদ্যথর্ব নিরামন্ত মুর্দ্ধো বিশ্বয় বাঘতঃ ।।
অর্থাৎ তুমিই পুরষ্য (প্রাণীর ভোজনকারী), সমগ্র জগতের আশ্রয়। হে আগুন! অথর্ব প্রথম তোমাকে মন্থন করেছিল। হে আগুন! অথর্বণ পদ্ম দিয়ে মন্থন করে পুরোহিত জগতের মস্তক থেকে তোমাকে আবির্ভূত করলেন।
জরথুষ্ট্রীয় গ্রন্থ আবেস্তায় লেখা আছে যে, অথর্বণ নামক একজন পুরোহিত কাঠ দিয়ে কাঠ ঘষে আগুন উৎপন্ন করতেন। দ্বিতীয় ‘গাহ’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত গৃহ থেকে যার অর্থ ঘর। সুরখানি একটি ফার্সি শব্দ, যার সংস্কৃত অর্থ ‘ঈশ্বরের খনি’, যা অসুরদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সুর দেবতাদের জন্য ব্যবহৃত হয়।
আজারবাইজানের এই মন্দিরটি হিন্দু দেবী জ্বালা দেবীকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এখানে আগুন অনবরত প্রজ্বলিত থাকে এবং পটভূমিতে গায়ত্রী মন্ত্র বাজানো হয়। মন্দিরে স্থাপিত একটি শিলালিপিতে সংস্কৃতে লেখা আছে, শ্রী গণেশায় নমঃ। দ্বিতীয় শিলালিপিতে, পবিত্র শিখার পবিত্রতার তারিখটি বিক্রম সংবত ১৮০২ হিসাবে লেখা আছে যা ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দ। মন্দিরটিতে একমাত্র ফার্সি শিলালিপি রয়েছে যেখানে শিখা পবিত্র করার তারিখটি ১১৫৮ হিজরি লেখা রয়েছে।
পার্সি ক্যালেন্ডার কাদিমিতে,১১৫৮ হিজরি ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দের সমান। অন্য একটি শিলালিপিতে পাঞ্জাবীতে লেখা আদি গ্রন্থ থেকে সত শ্রী গণেশায় নমঃ এবং প্রার্থনা মন্ত্র রয়েছে । আরও একটি শিলালিপিতে, দেবনাগরী লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় ভগবান শিবকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। শিলালিপিতে স্বস্তিক প্রতীক ও ত্রিশূলও তৈরি করা হয়েছে। ১৮ শতকে মুম্বাই থেকে পার্সিরা এই মন্দিরে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে এখানে পূজার জন্য ক্রমাগত পার্সি পুরোহিতদের পাঠানো হচ্ছে।
স্যার জে হেনরি তার ১৯০৫ সালে লেখা বইতে লিখেছেন যে শেষ ভারতীয় পার্সি পুরোহিত ১৮৬০ সালে মুম্বাই থেকে পাঠানো হয়েছিল এবং ১৮৮০ সালে বাকুতে মারা যান তিনি । বাকুর ইতিহাসে কোথাও একে পারসি মন্দির বলা হয়নি । এটিকে ‘হিন্দু’ বা ‘ভারতীয় মন্দির’ হিসেবে লেখা হয়েছে । ইউরোপীয় ঐতিহাসিক জোনাস হ্যানওয়ে লিখেছেন যে গেবর (পারসি সন্ন্যাসী) এবং গৌড় (হিন্দু পুরোহিত) এবং উভয়েই এই মন্দিরে উপাসনা করতেন।
কিন্তু ইতিহাসবিদ এভি উইলিয়াম জ্যাকসন তার দাবিকে খণ্ডন করেন এবং বলেন যে উভয় দলই ভারতীয় হিন্দুদের অন্তর্ভুক্ত যারা কপালে তিলক লাগাতেন। অনেক পার্সি পণ্ডিতও এটিকে পারসি মন্দির বলে মনে করেন না। বিখ্যাত পার্সি ইতিহাসবিদ ও পণ্ডিত স্যার জেজে মোদী বহু বছর ধরে এই মন্দির পরিদর্শন করেছেন এবং প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থের সাথে তথ্য মেলানোর পরে, তিনি দাবি করেছেন যে এটি একটি হিন্দু মন্দির যা জ্বালা দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এটি হিমাচলের কাংড়া মন্দিরের জ্বলা দেবী মন্দিরের একটি বড় সংস্করণ ।।