প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০২ এপ্রিল : কয়লা পাচার মামলায় ইডি-র দপ্তরে হাজিরা দেওয়ার ঠিক একদিন আগে আততায়ীদের গুলিতে নিহত হলেন কুখ্যাত কয়লা মাফিয়া । তার নাম রাজু ঝা(৫২)।শনিবার রাত ৮ টা নাগাদ এই শুট আউটের ঘটনাটি ঘটেছে পূর্ব বর্ধমানের শক্তিগড়ে কলকাতা মুখী ২ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে ল্যাংচার দোকানের সামনে। নীল রঙের একটি দামি চারচাকা গাড়িতে চড়ে আসা দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে মৃত্যু হয়েছে সাদা রংয়ের ফরচুনা গাড়িতে শওয়ার থাকা কয়লা মাফিয়া রাজু ঝার।গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর জখম হয়েছেনএকই গাড়িতেই শওয়ার থাকা রাজুর সহযোগী ব্রতীন মুখোপাধ্যায় । তাঁর বাম হাতে গুলি
লেগেছে । অস্ত্রোপচারের পর ব্রতীন এখন বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।তবে এত কিছুর মধ্যেও আশ্চর্যজনক ভাবে দুস্কুতিদের ছোড়া গুলির একটিও স্পর্শ করেনি ফরচুনা গড়ির চালক নুরুল হোসেন ওরফে নূর কে। এই বিষয়টি পুলিশকেও ভাবিয়ে তুলেছে। বারো সদস্যের শিট গঠন করে পুলিশ রাজু ঝা কে খুনের ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। সিআইডি আলাদা ভাবে এই খুনের ঘটনার তদন্ত শুরু করবে কিনা সেই বিষয়টি এখনও পরিস্কার নয় ।তবে সূত্রের খবর সিবিআই ও ইডি রাজু ঝা-র খুন হওয়ার ঘটনা বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছে
এদিকে এই শুট আউটের ঘটনায় ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়েছে শক্তিগড়ে জাতীয় সড়কের ধারে থাকা ব্যবসায়ী মহলে। আতঙ্ক এখনও যেন পিছু তাড়া করে বেড়াচ্ছে ল্যাংচা ব্যবসায়ীদের । যে খাবারের দোকানগুলির সামনে শনিবার রাতে শুট আউটের ঘটনা ঘটে সেই দোকানের মালিক ও কর্মচারীরা
রবিবার মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। এদিন ঘটনাস্থলে পৌছে দেখা যায় ঘটনাস্থল ও তার থেকে ফুট ২০ -২৫ দূরে রক্তের দাগ। মূল ঘটনাস্থল ছাড়াও ওই জায়গাটি ব্যারিকেড করে রেখেছে। শনিবার রাতেই ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েকটি গুলির খোল পায় পুলিশ। এদিন সন্ধ্যায় ফরেন্সিক টিম ঘটনাস্থলে তদন্তে আসে । তারা ঘটনাস্থল খুঁটিয়ে দেখেন। ঘটনাস্থল থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন।ফরেন্সিক দলের সদস্যরা জানিয়েছেন, মোট ১৩ টি গুলির খোল উদ্ধার হয়েছে। আততায়ীরা যে গাড়িটি লক্ষ করে গুলি চালিযে ছিল সেই গাড়িটিও পরীক্ষা করা হবে বলে ফরেন্সিক দলের সদস্যরা জানান।
ঘটনার পরে জাতীয় সড়ক ও তার আসপাশের সমস্ত সড়ক পথে নাকা চেকিংয়ে নামে জেলার বিভিন্ন থানার পুলিশ । তদন্তের স্বার্থে ঘটনাস্থল এলাকার একাধিক দোকানের সিসিটিভির হার্ড ডিস্ক পুলিশ সংগ্রহ করেছে । আততায়ীদের খোঁজ পেতে পুলিশ ফরচুনা গাড়ির চালক নুরুল হোসেন ছাড়াও ঘটনার সময়ে ঘটনাস্থলে থাকা আবুজিয়া শেখকে এদিন শক্তিগড় থানায় বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালায় । অন্যান প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গেও পুলিশ কর্তারা কথা বলে।শনিবার অনেকটা রাতে ঘটনাস্থলে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে জেলার পুলিশ সুপার কামনাশিষ সেন জানিয়েছিলন, ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু হয়েছে। আততায়ীদের ধরার চেষ্টা চলছে। আততায়ীরা ধরা পড়বেই বলে পুলিশ সুপার দাবি করেছিলেন । কিন্তু ঘটনার ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে যাবার পরেও পুলিশ আততায়ীদের কারোর টিকি পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি ।
এরই মধ্যে শনিবার গভীর রাতে ঘটনাস্থল থেকে আনুমানিক ৩ কিলোমিটার দূরে এবং শক্তির থানা থেকে ৫০০ মিটার দূরে পুরানো জিটি রোডের উপরে যাত্রীবিহীন নীল রয়ের একটি দামি চারচাকা গাড়ির হদিশ পায় পুলিশ । সেই গাড়িটির ভিতর থেকে পুলিশ গেরুয়া রঙের একটি উত্তরীয় কিছু কার্তুজ ও একটি আগ্নেআস্ত্র পেয়েছে বলে স্থানীয়রা দাবি করলেও পুলিশ কর্তারা এই বিষয়ে এদিন কিছু খোলসা করেন নি । রবিবার বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ মর্গে রাজু ঝার দেহের ময়নাতদন্ত হয়। তার পরিবারের লোকজন এদিন মর্গে উপস্থিত থাকেন। হাসপাতাল সূত্রে খবর রাজু ঝার শরীরে ছয়টি গুলি লেগেছিল ।
শক্তিগড়ে জাতীয় সড়কের দু’ধারে রয়েছে ল্যাংচা সহ অন্যান্য মিষ্টান্ন বিক্রির একাধিক দোকান। সন্ধ্যার পর দূরদূরান্তে যাতায়াত করা গাড়ির আরোহীরা ওইসব ল্যাংচার দোকানে দাঁড়িয়ে খাওয়া দাওয়া সারেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী শনিবার রাত ৮ টা নাগাদ কলকাতা মুখি রোডে শক্তিগড়ের একটি ল্যাংচা দোকানের সামনে দাঁড়ায় সাদা রংয়ের একটি ফরচুনা গাড়ি। ওই গাড়ির আরোহীরা, গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই নীলচে রঙের একটি চারচাকা গাড়ি সেখানে এসে দাঁড়ায়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীলচে রঙের গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমেই একেবারে শার্প শুটারের কায়দায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই ফরচুনা গাড়ির আরোহীদের লক্ষ্য করে পরপর গুলি চালায়। গুলি চালিয়েই নীলচে রঙের গাড়িতে চেপেই দুষ্কৃতীরা দ্রুত কলকাতা মুখি রোড ধরে পালিয়ে যায়। ওই নীল চারচাকা গাড়ি আগে আগে একটি বাইকে চেপে তিন যুবক যাচ্ছিল । বাইক আরোহীরা নীল গাড়িটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে ।
ঘটনাস্থল এলাকার দোকানে কাজ করা এক কর্মী এদিন দাবি করেন পর পর গুলি ছোড়ার আওয়াজ তাঁরা পান । তাঁর মতে কমবেশি ৯-১০ রাউণ্ড গুলি চালায় দুষ্কৃতীরা । গুলিতে ফরচুনা গাড়ির চালকের পাশের সিটে বসে থাকা ব্রতীন মুখোপাধ্যায় এবং পেছনের শিটে বসে থাকা রাজু ঝা গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দুস্কৃতিদের ছোঁড়া একটিও গুলি ফরচুনা গাড়ির চালকে স্পর্শ করেনি ।গুলিবিদ্ধ দু’জনকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা ঘটনাস্থলের অদূরের অনাময় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করা হয় । সেখানে চিকিৎসকরা রাজু ঝাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।অপর জনের বাম হাতে গুলি লাগায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান ।একেবারে ফিল্মি কায়দায় শুট আউটের ঘটনা ঘটিয়ে আততায়ীরা পালয়া বলে ওই কর্মী জানিয়েছেন ।
দুষ্কৃতী হামলার শিকার ফরচুনা গাড়ি চালক নূর হোসেন রাতে জানান,তারা দুর্গাপুর থেকে কলকাতা যাচ্ছিলেন । শক্তিগড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তিনি ঝালমুড়ি আনতে যাচ্ছিলেন বলে জানান । তবে তাদের গাড়িতে কজন আরোহী ছিল এবং তাদের পরিচয় বিষয়ে কিছু বলতে চায় ন ফরচুনা গাড়ির চালক । এর খানিক পরেই ঘটনাস্থল থেকে ২০- ২৫ ফুট দূরে রক্তের দাগ দেখতে পাওয়া যাবার পর সবাই ধরে নেন গাড়িতে চতুর্থ কোন ব্যক্তির উপস্থিতি ছিল। গুলিতে জখম হবার পর গাড়ি থেকে নেমে ওই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে ওই ব্যক্তি গা ঢাকা দিয়েছেন বলেই সবাই ধরে নেন । পরে ফরচুনা গাড়ির নম্বার ধরে খোঁজ চালিয়ে জানা যায় ওই গাড়ির মালিক হলেন সিবিআই এর তদন্তাধীন গরু পাচার মামলায় অন্যতম ফেরার অভিযুক্ত আব্দুল লতিফ। চতুর্থ ব্যক্তি আব্দুল লতিফ-ই হবেন বলে সবার সন্দেহ জাগে। যদিও পুলিশ ফরচুনা গাড়িতে চতুর্থ ব্যক্তির উপস্থিতি অস্বীকার করে ।
রাজু ঝার মৃত্যুর কারণ গ্যাং ওয়ার, না কি পরিকল্পনা করে খুন তা নিয়ে রহস্য রয়েই গিয়েছে। কুখ্যাত কয়লা মাফিয়া হিসেবেই পশ্চিম বর্ধমান জেলায় পরিচিত ছিলেন রাজু ঝা।প্রথমে কয়লাবাহী গাড়ির খালাসীর কাজ । তার পর কয়লা মাফিয়া ডন বনে যায় রাজু ঝা । বাম আমলে তার কারবারী প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ে । দুর্গাপুর ,আসানসোল থেকে শুরু করে ডানকুনি সর্বত্র কয়লা পাচারের মাধ্যম ছিল রাজুর প্যাড । সময় গড়ানোর সাথে সাথে রাজু ঝা হেটেল ও আবাসন ও বিলাসবহুল বাসের ব্যবসায় নামে। তবে তাকে নিয়ে বিতর্ক রয়েই গিয়েছিল ।
বিভিন্ন থানায় রাজু ঝার নামে অভিযোগ জমা পড়ে । সিআইডি ইতিপূর্বে তাকে গ্রেফতার করেছিল। ২০২১ শের বিধানসভা ভোটের আগে রাজু ঝা বিজেপিতে যোগ দেয়। কয়লা পাচার নিয়ে এখন সিবিআই ও ইডি যে তদন্ত চালাচ্ছে তার স্ক্যানারেও রাজু ঝা ছিল ।কয়লা মাফিয়া রাজু ঝার সঙ্গে আব্দুল লতিফের ও এনামুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে খবর মিলেছে। সোমবার রাজু ঝার ইডি দপ্তরে হাজিরা দেবার কথা ছিল । তার ঠিক একদিন আগে রাজু ঝার খুন হওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। রাজু ইডির কাছে সব সত্য কবুল করলে অনেক প্রভাবশালীরা ফেঁসে যেতে পারতেন?সেই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। উত্তর খুঁজছে নানা মহল ।।