প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৪ জানুয়ারি : আবাস যোজনা নিয়ে দুর্নীতি কাণ্ডে এবার যথেষ্টই বিপাকে পড়লো তৃণমূল কংগ্রেস ও পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ ।“পূর্ব বর্ধমানের জমালপুরের কাঠুরিয়া পাড়া গ্রামে থাকা নীল-সদা রঙের তৃণমূলের ’উন্নয়ন ভবনটি’ তৈরি হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পেই।কিন্তু ওই ভবনটির জমি উপভোক্তা শংকর মাঝির নামে না থাকলেও সেখানেই ’জিও ট্যাগিং’ করা হয়েছিল ।আবার একই উপভোক্তার নামে এলাকায় সেচ দফতরের বাঁধের জায়গায় একটি বাড়ি রয়েছে । সেই বাড়ির দেওয়ালেও লেখা রয়েছে ’বাংলা আবাস যোজনা’ এবং একই উপভোক্তার নাম“।এর তদন্তে নেমে ব্লক প্রশাসনের কর্তারা নিশ্চিৎ হয়েছেন, সরকারী অনুদানে তৈরি বাড়ি নিয়ে “দুটি বেআইনি“ কাজ হয়েছে“ ।এটা জানার পর বিরোধীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছে,এর পরেও প্রশাসন যদি এই বেআইনি কাজে যুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা না নেয় তাহলে তাঁরা বৃহত্তর আন্দোলনে নামবেন।
জামালপুর ২ পঞ্চায়েত অফিসের সন্নিকটে রয়েছে কাঠুবিয়াপাড়া গ্রাম। শঙ্কর মাঝি ও তাঁর পরিবার এই গ্রামেরই বাসিন্দা।২০১৮-১৯ অর্থ বর্ষে শঙ্কর মাঝির নামে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘর অনুমোদন হয়।যার আইডি নম্বর পিএমএওয়াই – ডাব্লু বি ১৬৮৫৩৩২।ঘর তৈরির জন্য ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা উপভোক্তা শঙ্কর মাঝির নামে বরাদ্দ হয়।সেই টাকায় পাকা বাড়ি তৈরি হয়ে যাবার পর নিয়ম মেনে তার ’জিও ট্যাগিং’ হয়।কিন্তু এত কিছুর পরেও ওই বাড়িতে শঙ্কর মাঝি বা তাঁর পরিবারের কারুরর্ই ঠাঁই হয় না।সেটি হয়ে যায় তৃণমূল কংগ্রেসের বিলাশবহুল উন্নয়ন ভবন।জেলা ও ব্লক তৃণমূলের এক ঝাঁক নেতা নেত্রী মিলে ওই পার্টি অফিসের উদ্ধোধন করেছিলেন।উন্নয়ন ভবনের ভিতরে রয়েছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর ছবি।এছাড়া রয়েছে এলইডি টিভি ও দামি আসবাবপত্র । উন্নয়ন ভবন তৈরির আসল রহস্য গোপন রেখেই তৃণমূলের এক গোষ্ঠীর নেতা রামরঞ্জন সাঁতরা ওরফে বুটে সহ অন্য নেতারা সেখানে বুক ফুলিয়েই ঢোকেন,আবার বুক ফুলিয়েই বেরিয়ে যান ।
এই বিষয়টি জানতে পারার পরেই ২০১৯ সালের জুলাই মাস নাগাদ বিজেপি যুব মোর্চার কর্মীরা আন্দোলনে নামেন । তখন চাপে পড়ে গিয়ে ব্লকের ওই তৃণমূলের নেতারা এবং জামালপুর ২ পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষõ ভোল বদলান।পার্টি অফিসটি ছেড়ে দেওয়া হয় উপভোক্তা শঙ্কর মাঝিকে।পঞ্চায়েত প্রধান মণিকা মুর্মু ও উপ-প্রধান উদয় দাস ঘরের চাবি তুলে দেন শঙ্কর মাঝির হাতে।এমনকি তৃণমূলের উন্নয়ন ভবনটি যে আসলে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকায় তৈরি উপভোক্তা শঙ্কর মাঝির বাড়ি ,কেই কথাও পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ ওই উন্নয়ন ভবনের দেওয়ালে লিখেদেন।তার পর আন্দোলন স্ফিত হতেই উপভোক্তা শঙ্কর মাঝিকে উন্নয়ন ভবণ থেকে বেরকরে দেওয়া হয়। উন্নয়ন ভবনের দেওয়ালে লেখা থাকা আবাস যোজনা সংক্রান্ত তথ্যও মুছে দেওয়া হয়। তার পর শঙ্কর মাঝি ও তাঁর পরিবারের ঠাঁই হয় গ্রাম থেকে খানিক দূরে সেচ দফতরের বাঁধের জায়গায় ।এর কারণ জনতে চাওয়া হলে তৃণমূল নেতা রামরঞ্জন সাঁতরা গোটা ঘটনার জন্য জামালপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করেন। পাশাপাশি তিনি এও জানান,নিজের থেকে ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি শঙ্কর মাঝির জন্য সেচ দফরের বাঁধের জায়গায় ইটের দেওয়াল আর এডবেস্টার ছাউনির বাড়ি তৈরি করে দেন। লেখক দিয়ে ওই বাড়ির দেওয়ালেই তিনিই শঙ্কর মাঝির প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়ি পাওয়া সংক্রান্ত তথ্য ও ,আই-ডি নম্বরও লিখে দিয়েছেন বলে জানান। একই সঙ্গে রামরঞ্জন সাঁতরা এও দাবি করেন উন্নয়ন ভবনের জায়গার সঙ্গে শঙ্কর মাঝির সরকারী আবাস যোজনার বাড়ি কোন সম্পর্ক নেই ।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে শঙ্কর মাঝির আবাস যোজনার বাড়ি নিয়ে সম্প্রতি নতুন করে বিতর্ক তৈরি হতেই তদন্তে নামে জামালপুর ব্লক প্রশাসন ।
সেই তদন্ত রিপোর্টে মেনে নেওয়া হয়েছে,শঙ্কর মাজির আবাস যোজনার বাড়ি নিয়ে পরপর দু’টি ‘ভুল’ হয়েছে। রিপোর্টে এও বলা হয়েছে,খাঁপুর মৌজায় নির্মীয়মান বাড়িটিকেই প্রয়াত উপভোক্তা শঙ্কর মাঝির বলে দেখানো হয়েছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থ বর্ষে বাড়ি তৈরির জন্যে তিনটি কিস্তিতে শঙ্কর টাকায় তুলে নিয়েছিলেন।
চূড়ান্ত পর্যায়ে সেখানেই তার ‘জিও ট্যাগিং’ও করা হয়েছিল সে কারণে নীল-সাদা রঙের বাড়িটি প্রশাসনের খাতায় শঙ্কর মাঝির বলেই উল্লেখিত রয়েছে।সেই কারণেই ওই বাড়ির গায়ে ‘বাংলা আবাস যোজনা’লিখেছিল স্থানীয় পঞ্চায়েত । যদিও যে জমিতে সরকারী আবাস যোজনার বাড়িটি তৈরি হয় সেই জায়গাটি আদতে শঙ্কর মাঝিরই নয়। ফলে,ওই জায়গায় আবাস প্রকল্পের বাড়ি হলেও তা ‘বেআইনি’ ভাবেই হয়েছে ।
এই রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রশ্ন উঠেছে,উপভোক্তার নামে আবাস যোজনার রেজিস্ট্রেশন হয়ে যাওয়া ও তার পর তিন কিস্তিত সরকারী টাকা তুলে নেওয়ার পর বাড়িটা তৈরি হোল কোথায় ? দামোদরের ধারে সেচ দফতরের বাঁধের জায়গায় তো সরকারী আবাস যোজনার বাড়ি তৈরি করা যায় না। নিজস্ব জমি দেখাতে না পারলে কেউ তো ’প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার’ উপভোক্তা হিসেবে বাড়িও পেতে পারেন না । তাহলে সরকারী টাকা তুলে নেওয়া হলেও সরকারী আবাস যোজনার বাড়ি কি আদৌ তৈরি হয় নি। পুরো টাকাটাই কি কেউ আত্মসাৎ করে নিয়েছে? এই প্রশ্নই এখন রাজনৈতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে।পঞ্চায়েতের উপ-প্রধানের উদয় দাসের দাবি, পঞ্চায়েতের খাতাতে নীল-সাদা রঘের বাড়িটি শঙ্কর মাঝির বলেই ওই বাড়ির দেওয়ালে তা উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছিল’। বিডিও (জামালপুর) শুভঙ্কর মজুমদার জানিয়েছেন, “প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্ট জেলায় জমা দেওয়া হয়েছে। জেলা যেমন নির্দেশ দেবে, সে রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপভোক্তা উপভোক্তা শঙ্কর মাঝির নাতনি পূজা মাঝি সব শুনে মঙ্গলবার দাবি করে,কাঠুরিরাপাড়া গ্রামের বাড়িটা তাঁর দাদুর না হলে তাহলে কে দাদুকে ওই বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হয়েছিল ? কেনই বা ওই বাড়িটার দেওালে ‘বাংলা আবাস যোজনা’ লিখে পঞ্চায়েত তাঁর দাদুর নাম লিখে দিয়েছিল। পরে আবার কেন ওই বাড়ির বদলে দামোদরের বাঁধের জায়গায় বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হল?” বিজেপির যুব মোর্চার জামালপুরের আহ্বায়ক অজয় ডোকাল বলেন,প্রকৃত উপভোক্তার ঘাড়ে বন্দুক রেখে তৃণমূল সরকারি প্রকল্পের টাকা লুট করেছে।“তৃণমূলকে বাঁচাতে এই আসল সত্য আড়াল করে প্রসাসন মনগড়া একটা রিপোর্ট তৈরি করেছে বলে অজয় ডকাল দাবি করেছেন“। তবে ব্লক তৃণমূলের সভাপতি মেহেমুদ খান জানিয়েছেন, “তদন্ত রিপোর্টে কেউ দোষী হলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে ।।