এইদিন ওয়েবডেস্ক,২৪ অক্টোবর : ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু বা খ্রিস্টানরাই নয়, মুসলিম মেয়েরাও সুরক্ষিত নয় । পাকিস্তানি মুসলিম তরুনী, কিশোরী বা শিশুকন্যারা তার পরিবারের মধ্যেই ঠিক কতটা অসুরক্ষিত তার এক ঝলক তুলে ধরেছিলেন পাকিস্তানের তেহরিক-ই- ইনসাফ দলের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য শান্দানা গুলজার খান । তিনি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল লিগ এবং মিলি মুসলিম লীগের সদস্যরা । পাকিস্তানের একটা টিভি চ্যানেলে ‘জয়নবের হত্যাকারীর ফাঁসি হলেও অপরাধ কমেনি কেন?’– শীর্ষক একটা টক শো অনুষ্ঠানে ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের সমাজের এই কদর্য রূপ তুলে ধরেছিলেন তিনি ।
শান্দানা গুলজার খান বলেন, ‘আমাদের একটা এনজিও ছিল ওয়্যার এগেনস্ট রেপ(ওএআর) । ওই এনজিও একটা পরিসংখ্যানে বলেছিল যে যখন পাকিস্তান এই ইস্যু ট্যাকেল করবে তখন রেভোলিউশন হবে,এভেলিউশন হবে এবং রেজিস্টেন্সও বাড়বে ৷ গাইনোকোলজিস্ট ও নির্যাতিতাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে ধর্ষণ কে করেছে ? তার মধ্যে ৮২ শতাংশ অভিযোগ করেছে যে বাবা,কাকা, দাদু, ঠাকুরদা, মামা অথবা নিজের ভাইয়ের দ্বারা তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে ।’
তিনি বলেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষক নিজের লোক হওয়ায় ঘটনা থানা পর্যন্ত পৌঁছায় না । পরিবর্তে মেয়েটির গর্ভপাত করানো হয় । উল্টে নির্যাতিতার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে বলা হয় যে ‘আমার মেয়ে দুপাট্টা পরে নাই, এই কারণে ধর্ষণের শিকার হয়েছে’ । আমি এই বিষয়ে তিন বছর ধরে কাজ করেছি । পাকিস্তানের সমাজের এটা একটা কদর্য রূপ…কোন শয়তান এই কাজ করে না মানুষই করে । যদি এর মূল সমস্যার ভেতরে ঢুকে মানুষ কথা বলে তাহলে এই সমস্যার সুরাহা হয় । কিন্তু সমাজের কেউ এই বিষয়ে কথা বলতেই চায় না ।’
তিনি বলেন,’পরিবারের লোকের কাছে ধর্ষিতা হওয়ার পর যে মেয়েরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে, তাঁরা পুলিশের কাছে না গিয়ে গর্ভপাত করাতে যান। তাদের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান তাঁদের মায়েরাই। সন্তানকে পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠলে মায়েরা বলেন যে তারা তাঁদের স্বামীদের ছেড়ে যেতে পারবেন না।’ এই ঘটনাকে দেশ এবং সমাজের অন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের সামা টিভির ওই অনুষ্ঠানটি ছিল গত বছরের । তার আগের বছর অক্টোবরের একটি সমীক্ষার রিপোর্ট অনুসারে পাকিস্তানে প্রতি দু’ঘণ্টায় একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে হত্যার ঘটনাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ওই ইসলামি রাষ্ট্রে । চ্যানেল তদন্তকারী ইউনিট পাঞ্জাবের স্বরাষ্ট্র দফতর এবং মানবাধিকার মন্ত্রকের থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি সমীক্ষায় দেখেছিল যে পাকিস্তানে ধর্ষণের ঘটনা বাড়লেও অভিযুক্তের শাস্তির হার খুবই কম। অর্থাৎ এমন একটি গুরুতর অপরাধ করেও ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে অপরাধী। সমীক্ষায় আরও জানা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল অবধি ২১ হাজার ৯০০ জন মহিলার ধর্ষণের ঘটনা সামনে এসেছে। এর অর্থ দেশজুড়ে প্রতিদিন ১২ জন মহিলার ধর্ষণ হয়। অথবা প্রতি দু’ঘণ্টায় একজন মহিলার ধর্ষণ হয় পাকিস্তানে। সমীক্ষা থেকে আরও জানা গিয়েছে, বাস্তবে আরও অনেক বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সামাজিক কারণে সেগুলি সামনে আসে না।
পাকিস্তানের নারী বিষয়াবলি সংক্রান্ত অধ্যাপক শাহলা হায়েরির মতে, পাকিস্তানে ধর্ষণ প্রায়ই সংগঠিত এবং এতে রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ও কখনো কখনো প্রকাশ্য সমর্থন থাকে । আইনবিদ আসমা জাহাঙ্গীরের মতে, পাকিস্তানে কারারুদ্ধ নারীদের ৭২ শতাংশেরও বেশি শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার । ২০০৯ সালে পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে হত্যাকাণ্ডের শিকার ৪৬ শতাংশই হচ্ছেন সম্মানজনিত হত্যাকাণ্ড বা অনার কিলিং-এর শিকার ।
পাকিস্তানের কিছু উল্লেখযোগ্য গনধর্ষণের ঘটনা হল :
২০১২ সালে পাকিস্তানের সীমান্ত পুলিশের তিন সদস্যকে ১৫ থেকে ২১ বছর বয়সী পাঁচজন মেয়েকে গনধর্ষণের অভিযোগে হেফাজতে নেওয়া হয়। নির্যাতিতারা দাবি করেন যে, তাঁদেরকে দেরা গাজী খানের একটি অঞ্চল থেকে বন্দি করে পুলিশ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানোর সময় পুলিশ সদস্যরা দৃশ্যটি ভিডিও করে ।
২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি বাহাওয়ালপুরে একটি ৯ বছর বয়সী মেয়েকে অপহরণের পর গণধর্ষণ করা হয় । ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে পেশোয়ারে একজন নারী গণধর্ষণের শিকার হন। পরবর্তীতে আদালত অভিযুক্তদের মুক্তি দেয় । ২০১৩ সালের ২২ জুন লাহোরে একজন নারী ১৩ জন পুরুষের দ্বারা উপর্যূপরি গণধর্ষণের শিকার হন । ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর করাচিতে একটি পোলিও-আক্রান্ত মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয় । ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মুখতারান বিবি ২০০২ সালে যে জেলায় ধর্ষিত হয়েছিলেন সেই মুজাফফরগড় জেলাতেই একটি গ্রামপরিষদের নির্দেশে এক নারীকে গণধর্ষণ করা হয় ।।২০১৪ সালের ১৯ জুন পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লায়াহ জেলায় ২১ বছর বয়সী এক নারীকে গণধর্ষণ ও হত্যা করা হয় । ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফয়সালাবাদে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য মিঞা ফারুকের তিন ছেলে একটি অল্পবয়স্ক মেয়েকে অপহরণ ও গণধর্ষণ করে। পরে আদালত ধর্ষকদের মুক্তি দেয় । উল্লেখ্য যে সংখ্যালঘু ও নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের আইনব্যবস্থার ন্যাক্কারজনক ভূমিকায় সেদেশের অপরাধ প্রবণতার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য দায়ি করা হয় ।।