শেখ মিলন,ভাতার(পূর্ব বর্ধমান),২৯ ডিসেম্বর : ‘জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় মাসের আগুন ঝরানো রোদে জমির আলে একটা ছাতা খুলে তার নিচে আমায় বসিয়ে রেখে মা-বাবা জমিতে ধানবীজ রোপনের কাজ শুরু করলেন । অল্প কিছুক্ষণ কাজ করার পরেই দু’জনেরই পরনের সব পোশাক ঘামে ভিজে গেল । চোখের সামনে মা-বাবার ওই কষ্ট দেখে আমি মনে মনে খুব কষ্ট পেতাম । ইচ্ছা করত জমির কাদায় নেমে একটা পাখা দিয়ে মা- বাবাকে হাওয়া করে আসি,যাতে একটু হলেও তাদের কষ্ট লাঘব হয় । কিন্তু আমি যে তখন খুব ছোট ।’ একথা বলার পর চোখ দুটো ভিজে গেল সেখ ইমাম উদ্দিনের । নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তিনি বলেন,’তখন থেকেই মা-বাবাকে দারিদ্রের চক্রবুহ্য থেকে বের করার স্বপ্ন দেখতাম মনে মনে । অবশেষে আল্লাহ আমার সেই প্রার্থনা শুনেছেন ।’
পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার থানার ওড়গ্ৰাম জঙ্গলমহল এলাকার বাসিন্দা সেখ ইমাম উদ্দিন । আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী । অর্থের অভাব নেই । ব্যবসার পাশাপাশি সমাজসেবার কাজও করেন তিনি । এলাকার দুঃস্থ মানুষের সাহায্যার্থে গড়ে তুলেছেন ‘ওরগ্রাম রামমোহন রুরাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি’ । সেই সোসাইটির অধীনে রয়ে বৃদ্ধাশ্রমও । সেখানে কিছু দুঃস্থ বৃদ্ধবৃদ্ধা রয়েছেন । তাদের ভরনপোষণের দায়িত্ব রয়েছে ইমাম উদ্দিনের কাঁধে । পাশাপাশি মাঝেমধ্যেই শারিরীকভাবে অসমর্থদের জন্য ট্রাইসাইকেল বিতরণ ও রক্তদান শিবিরের মত সমাজসেবার কাজও করেন ওই মধ্যবয়সী ব্যক্তি ।
কিন্তু সেখ ইমাম উদ্দিনের জীবনের শুরুটা কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে । মা-বাবা ছিলেন বিহারের বাসিন্দা ৷ পেশা ছিল ক্ষেতমজুরি । তারা ধানবীজ রোপন ও ধান কাটার কাজ করতে আসতেন সাহেবগঞ্জ-২ নম্বর অঞ্চলের মান্দারবাটি এলাকায় । সঙ্গে করে আনতেন ছোট্ট ইমাম উদ্দিনকে । ক্রমে সেখানেই থিতু হন ইমাম উদ্দিনের মা-বাবা । অভাবের মধ্যেও ছেলেকে স্কুলে পাঠান । ইমাম উদ্দিন বলেন, ‘মা-বাবার হাড়ভাঙা পরিশ্রম দেখে ছোট থেকেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি । একটু বয়স হতেই সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করি । প্রথম প্রথম ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করি । আস্তে আস্তে ব্যবসার পরিধি বাড়াই ।’ তিনি বলেন,’মা-বাবার সেই কঠিন জীবনের কথা ভেবে একটু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সমাজের দুঃস্থ মানুষদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করি ।’
সেখ ইমাম উদ্দিনের উত্থান যেকোনো বলিউড ছবিকেও হার মানাবে । আজ এলাকার মানুষ তাকে একডাকে চেনেন । প্রথম দিকে দরিদ্র মানুষকে সামর্থ্য মত আর্থিক সাহায্য করতেন তিনি । সমাজসেবাকে বৃহত্তর আকার দিতে পরবর্তী সময়ে গড়ে তোলেন ওরগ্রাম রামমোহন রুরাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি । বছর খানেক আগে অনাথ দুঃস্থ শিশুদের জন্য অনাথ আশ্রম গড়ে তোলেন । বর্তমানে সেখানে প্রায় ১৭ জন শিশু রয়েছে । তাদের পড়াশোনার জন্য রয়েছে একটা স্কুল । পড়াশোনাসহ তাদের যাবতীয় খরচখরচা চলে ইমাম উদ্দিনের অর্থানুকূল্যে । পাশেই রয়েছে বৃদ্ধাশ্রম। বর্তমানে প্রায় ৯ জন দুঃস্থ বৃদ্ধবৃদ্ধাকে বিনামূল্যে বিভিন্ন পরিষেবা দেওয়া হয়। এলাকার গরিব মানুষদের কথা ভেবে বিনামূল্য অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবারও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তিনি ।
সারা বছরই মানুষের পাশে দাঁড়ানোই প্রধান লক্ষ্য সেখ ইমাম উদ্দিনের । আজ রবিবার একাধিক জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নেন সংস্থার কর্ণধার শেখ ইমাম উদ্দিন। এদিন একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল । শতাধিক মানুষ রক্তদেন । পাশাপাশি এলাকার শতাধিক অসহায় মানুষের হাতে শীত বস্ত্র তুলে দেওয়া হয় সংস্থার পক্ষ থেকে । বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এক মহিলাকে ট্রাইসাইকেল দেওয়া হয় এদিন ।
ইমামবাবুর এই মানবিক কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক স্থানীয় বাসিন্দা সেখ আনোয়ার হোসেন৷ তিনি বলেন, আমাদের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজের জন্য কিছু নজিরবিহীন কাজ করে বিপরীতভাবে আমাদেরকেও কিছু শিক্ষা দিচ্ছেন আমাদের ছাত্র ইমাম উদ্দিন। তাঁর কর্মকান্ডে আমরা খুবই গর্বিত।’ অন্যদিকে শেখ ইমাম উদ্দিন বলেন,’দারিদ্রের যন্ত্রণাকে আমি খুব কাছ থেকে অনুভব করেছি। অতীতের ফেলে আসা সেই দিনগুলিকে আজও আমি ভুলতে পারি না । সেই কারনে সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি ।: আগামী দিনেও এভাবে মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চান সমাজসেবী সেখ ইমাম উদ্দিন ।
এদিনের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক সেখ আনোয়ার হোসেন, ওড়গ্রাম হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক তারাপদ পাল, বিশিষ্ট সমাজসেবী শিবানন্দ হাজরা, দীপক মন্ডল, সাহেবগঞ্জ দু নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান প্রদ্যুৎ কুমার পাল, বিল্লগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কিশোর রায় চৌধুরী, সহ অন্যান্যরা ।।