“পিরীতে মজিলে মন”- জাতপাত, ধর্মের বাধা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, পরিবারের শত বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় হিন্দু মেয়েরা । কিন্তু তাদের অনেকের প্রেমের নেশা অচিরেই কেটে যায় । কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েদের ফিরে আসার রাস্তাও চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় । ফলে তারা চিরতরে হারিয়ে যায় অন্ধকারের গভীর গহ্বরে ৷ কিন্তু ২০১৬ ব্যাচের আইএএস টপার তফসিলি জাতির টিনা দাবির (Tina Dabi) সামাজিক প্রতিষ্ঠা তাকে অন্ধকার গহ্বরে যেতে দেয়নি । স্বামী আতহার আমির-উল-শফি খানের (Athar Amir-ul-Shafi Khan ) অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে স্বধর্মে ফিরে এসেছেন । শুক্রবার বৈদিক আচার মেনে এবং পূজাপাঠের মধ্যে তিনি ফের পূর্বের ধর্মে ফিরে এসেছেন বলে কিছু এক্স হ্যান্ডেলে দাবি করা হয়েছে । শুধু তাইই নয়,বৈদিক রীতি অনুসারে তিনি নাকি প্রদীপ গোয়ান্দে নামে এক হিন্দু যুবককে বিয়েও করেছেন বলে জানানো হয়েছে।
কাশ্মীরের বাসিন্দা আতহার খান ২০১৫ সালে ইউপিএসসি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন, আর টিনা দাবি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলেন। শফি মাত্তান শহরের বাসিন্দা, আর টিনা দাবি দিল্লির বাসিন্দা । শফি তার নিজের রাজ্য ক্যাডার এবং টিনা দাবি হরিয়ানার, দুজনেই রাজস্থান ক্যাডারের আইএএস পেয়েছিলেন। প্রথম দেখাতেই তাদের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি হয় । ২০১৬ সালে দিল্লির ডিপার্টমেন্ট অফ পার্সোনেল অ্যান্ড ট্রেনিং (DoPT) অফিসে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি পোস্ট করার পর দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ পায় এবং আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের বিয়ের ছবি পোস্ট করে যা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।
আতহারের আচার আচরণ ও কথাবার্তায় প্রভাবিত হন টিনা । প্রথমে ফোনে খোঁজখবর নেওয়া এবং পরে একাধিকবার মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয় দু’জনের । আতহার তাকে এতটাই প্রভাবিত করতে সক্ষম হন যে তার আবদার মেনে ধর্ম পরিবর্তন করে তাকে নিকাহ করেন টিনা । নিজের নাম পরিবর্তন করেননি ঠিকই, তবে নিজের আসল পদবির পাশাপাশি স্বামীর পদবি “খান” যুক্ত করেন টিনা । টিনা এবং আতহারের বিয়ে হয়েছিল ৭ এপ্রিল, ২০১৮ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের পাহালগামে। রাহুল গান্ধী,তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি এম ভেঙ্কাইয়া নাইডু, লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবি শঙ্কর প্রসাদ সহ বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা তখন এই দম্পতিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন, কিন্তু হিন্দু মহাসভা টিনা দাবির সিদ্ধান্তকে ‘লাভ-জিহাদ’ বলে অভিহিত করেছিল। প্রতিবেদন অনুসারে, হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা, টিনার বাবাকে একটি চিঠি লিখে তাকে তাদের দুজনের বিয়ের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানায় ।

কিন্তু বিয়ের ঠিক দু’বছরের মাথায় টিনা দাবি সোশ্যাল মিডিয়ায় তার পদবি থেকে ‘খান’ বাদ দেওয়ার পর এবং আতহারও ইনস্টাগ্রামে টিনাকে আনফলো করার পর এই দম্পতির বিবাহিত জীবন সংবাদ শিরোনামে আসে। ২০১৮ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের আগে, এই দম্পতি তাদের সাফল্য এবং সামাজিক পটভূমির জন্য শিরোনামে ছিলেন। ভিন্ন ধর্মীয় পটভূমি থেকে আসা এই জুটি সমালোচনা সহ্য করেনি । মিডিয়া যখন এই বিষয়ে টিনা দাবির প্রতিক্রিয়া জানতে চায়, তখন তিনি বলেন: “আমি মনে করি জনসাধারণের নজরে থাকার জন্য এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে চর্চা করা হচ্ছে ।” এমনকি ধর্মীয় নিপিড়নের শিকার হয়ে রাজস্থানে আশ্রয় নেওয়া পাকিস্তানি হিন্দুদের ঝুপড়িতে বুলডোজার চালানোর অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছিল টিনা দাবির বিরুদ্ধে ।
প্রসঙ্গত,হিন্দু মহাসভা টিনা দাবির এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে একে ‘লাভ-জিহাদ’ বলে অভিহিত করেছিল । টিনা দলিত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, অন্যদিকে আতহার একজন মুসলিম। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা টিনার বাবার কাছে একটি চিঠি লিখে তাকে দুজনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ পর্যন্ত করেছিল । চিঠিতে, হিন্দু মহাসভা টিনা দাবির আতহার আমার-উল শফিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তকে ‘বেদনাদায়ক’ বলে উল্লেখ করে । এমনকি, সংগঠনটি টিনার বাবাকে আতহারকে ‘ঘর-ওয়াপসি’ বা হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়ে বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছিল । যদিও টিনা দাবি মিডিয়াকে আগেই জানিয়েছিলেন যে তিনি অবাঞ্ছিত ক্রোধের শিকার হচ্ছেন।
টিনা দাবি ও আতহার আমির-উল-শফি খানের প্রথম পোস্টিং হিসেবে, রাজস্থান ক্যাডারের আমির এবং টিনাকে ভিলওয়ারায় পোস্ট করা হয়েছিল। তারপর, টিনা রাজস্থানের গঙ্গানগরে এবং আমির জয়পুরে স্থানান্তরিত হয়েছিল । বিবাহিত হওয়ার সুবাদে তারা এক ছাদের মধ্যেই বসবাস করতেন । কিন্তু মাত্র ২ বছরের সংসার স্থায়ী হয় তাদের । শোনা যায়,স্বামী আখতার তাকে প্রচণ্ড নির্যাতন করতেন, মারধর করতেন এবং বোরখা ও নিয়মিত নামাজ পরতে বাধ্য করতেন । স্বামীর এই কট্টরপন্থী মানসিকতায় মাত্র দু’বছরের মধ্যেই “ধর্মনিরপেক্ষ” টিনা দাবির মাথা থেকে প্রেমের ভুত নেমে যায় । ফলে তাদের মধ্যে মতবিরোধ চরম আকার ধারন করে । অবশেষে ২০২০ সালের নভেম্বরে তাদের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ হয়ে যায় । এরপর আমির জম্মু ও কাশ্মীর ক্যাডারে বদলি নিয়ে চলে যান।
গত শুক্রবার রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগরে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন টিনা । সেখানেই একটা মন্দিরে গিয়ে ফের হিন্দু ধর্মে প্রত্যাবর্তন ও হিন্দু যুবককে বিয়ে করেছেন বলে জানানো হচ্ছে । কেউ কেউ দাবি করছেন যে টিনা দাবি এখন কট্টর হিন্দু বনে গেছেন এবং “লাভ জিহাদ”-এর বিরুদ্ধে লড়াই লড়ছেন । হিন্দুত্ববাদী এক্স ব্যবহারকারীরা লিখেছেন,এখন পর্যন্ত তিনি ৫০ জনেরও বেশি মেয়েকে লাভ জিহাদ থেকে বাঁচিয়েছেন । এমনকি লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সংগঠনগুলিকে টিনা দাবি সাহায্য পর্যন্ত করছেন বলে ওই এক্স হ্যান্ডেলগুলিতে দাবি করা হচ্ছে ।।