“বাবরি মসজিদ” ইস্যুতে মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের বহিষ্কৃত তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ূন কবীরের উত্থান বিধানসভার ভোটের আগে রাজ্য রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে । এখন আর তৃণমূলের সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বা ফিরহাদ হাকিম এরাজ্যের ৩০-৩৫ শতাংশ মুসলিমদের ব্রান্ড নয়,নতুন ব্রান্ড হিসাবে উত্থান ঘটে গেছে হুমায়ূনের । বাধ্য হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হুমায়ূনকে “আজীবনের জন্য সাসপেন্ড” করেছেন ঠিকই,কিন্তু ইতিমধ্যে ধর্মীয় মেরুকরণ যা হওয়ার হয়ে গেছে । আর এই কথিত “সাসপেন্সন” বুমেরাং হয়ে গেছে মমতার জন্য । কারন তার “কোর ভোটব্যাঙ্ক” ইতিমধ্যেই তাকে বাবরি মসজিদ নির্মানের বিরোধী বলে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছে ।
হুমায়ূন কবীরের উত্থানে শুধু তৃণমূলই বিপাকে পড়েনি, পাশাপাশি সিপিএম ও কংগ্রেস চরম বিপাকে পড়ে গেছে । এরাজ্যে কংগ্রেসের সেভাবে জনসমর্থন না থাকলেও বিশেষ করে হিন্দু নির্ভর সিপিএমের ভোটব্যাংকে যে এর প্রভাব পড়বে তা মোটামুটি নিশ্চিত । অন্যদিকে বাবরি মসজিদ সম্পর্কে ওয়াইসির অত্যন্ত উস্কানিমূলক এবং প্রদাহজনক বক্তব্য, স্পষ্টতই বাংলায় ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অস্থিরতার পূর্বাভাস দিচ্ছে । তোষামোদি রাজনীতি আরও ব্যাপক আকারে দেখা যাবে এবারের বিধানসভার ভোটে ।
২০২৬ সালের বিধানসভার ভোটের ঠিক মুখেই এই মারাত্মক খেলাটি কার খেলা তা বলা অসম্ভব, তবে খেলাটি গভীরভাবে রাজ্য রাজনীতির সাথে জড়িয়ে আছে । মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গায় “বাবরি মসজিদ” ইস্যুতে বিজেপি বারবার মমতার দিকে আঙুল তুললেও, তবে ভোটের ঠিক মুখেই তিনি এতবড় ঝুঁকি যে নেবেন বলে মনে হয় না৷ কারন, মমতা যদি নেপথ্যে থেকে এই খেলা খেলে থাকেন তাহলে তার প্রভাব হিন্দু ভোটব্যাংকের উপর পরবেই । তখন দিঘার জগন্নাথ মন্দির বা উত্তরবঙ্গের মহাকাল মন্দির দেখিয়েও সেই ক্ষতিপূরণ করতে পারবেন না তিনি । কিন্তু এটা স্পষ্ট যে এই খেলায় হুমায়ুন কবির হলেন একজন ঘুঁটি যিনি বাবরি মসজিদের নামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের একত্রিত করতে অনেকাংশেই সফল । মাথা অন্য কেউ । এখন প্রশ্ন কে বা কারা সেই মাথা ?
পাশাপাশি আরও একটা নাম বাংলার রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে গেছে । আর তিনি হলেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি । যিনি সর্বভারতীয় মজলিস- ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের (এআইএমআইএম) বর্তমান সভাপতি ও হায়দ্রাবাদের সাংসদ । ওয়াইসি কেবল বারবার বাবরি মসজিদের বিষয়টি উত্থাপন করছেন না, বিধানসভার ভোটে হুমায়ুন কবিরের “নতুন দলের” সাথে জোট করে তার দলের লড়ার ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে । ওয়াইসি বাংলার যে সমস্ত জেলায় মুসলিম জনসংখ্যা ৪৫% এর বেশি সেখানে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানিয়েছেন । তিনি ও হুমায়ূন যে সরাসরি ব্যাপক মুসলিম তোষামোদের রাস্তায় হাঁটবেন এটা নিশ্চিত । আর এই ধর্মীয় মেরুকরণের চক্রব্যুহে পড়ে মমতা ব্যানার্জির “খেলা” শেষ হয়ে যাবে !
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাবরি মসজিদ ইস্যুর পুরো খেলাটি বোঝেন ; কিন্তু তিনি এটিকে না পারছেন সমর্থন করতে, না বিরোধিতা । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উভয় পক্ষেরই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। একদিকে বেলডাঙ্গায় বাবরি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে ব্যাপক পুলিশের নিরাপত্তাকে ইস্যু করে বিজেপি এই পরিকল্পনার মাস্টারমাইন্ড হিসাবে মমতাকে তুলে ধরায় হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের ক্ষতি ; অন্যদিকে হুমায়ূনকে কথিত “সাসপেন্ড” করে বাবরি মসজিদ বিরোধী ইমেজ তৈরি হওয়ায় মুসলিম ভোটব্যাংকের ক্ষতির মুখে পড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে । আর ওয়াইসি এটাকেই কাজে লাগাতে চাইছেন ।
গত নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৫১% মুসলিম ভোট এবং ৪৩% হিন্দু ভোট পেয়েছিলেন। তাহলে ৪৯% মুসলিম ভোট কে পেয়েছে ? সেই সাথে এবারে এসআইআর-এর একটা বড় প্রভাব পড়বে তৃণমূলের ভোটব্যাংকে । কারন ইতিমধ্যেই মৃত,ভুয়ো ও স্থানান্তরিত ভোটার মিলে বাদ যাওয়া নামের সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়েছে । এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা বলা খুব কঠিন । তবে এসআইআর-এর কারনে একচেটিয়া ভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে তৃণমূল কংগ্রেস ।
সেই সাথে বাবরি মসজিদ ছাড়াও বাংলায় তোষণের আরও অনেক বিষয় উঠে আসবে । যা আরও মেরুকরণ নিশ্চিত করবে । ওয়াইসির যেকোনো মূল্যে বাংলায় ২৫% মুসলিম ভোট প্রয়োজন । হুমায়ূন ভরতপুর ও বেলডাঙ্গা ছাড়াও আরও মুসলিম অধ্যুষিত আসনে হাত বাড়নোর চেষ্টা করবেন । আর যদি এমনটা হয়, তাহলে পাঁচে প্রকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে অনেক দূরে থাকবেন। তবে এটা নিশ্চিত যে এবার বাংলায় বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসবে। যে ‘গেম খেলে’ মমতা ব্যানার্জি তিন মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই ‘গেম’ই এবার বুমেরাং হবে তার জন্য । কারন, ওই গেমের একাধিক ওস্তাদের আবির্ভাব ঘটে গেছে বঙ্গে ।
যদিও মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞায়-এর ডাকবাংলায় বিজেপি কার্যালয়ে যোগদান কর্মসূচিতে সাংবাদিক বৈঠকে জেলা সভাপতি মলয় মহাজন “বাবরি মসজিদ” ইস্যুকে মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে কারন বলে ব্যাখ্যা করেছেন । তার কথায়,’৭০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত জেলা হয়েও কেন মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের জেলা সভাপতি একজন হিন্দু হওয়াকে মেনে নিতে পারছেন না হুমায়ূন কবির । তিনি চাইছেন জেলায় দলের রাশ মুসলিমদের হাতে থাকুক। তাই তিনি ধর্মীয় মেরুকরণ করে দলনেত্রীকে একটা জোর ধাক্কা দিতে চাইছেন ।’ উল্লেখ্য,ওই যোগদান কর্মসূচিতে মলয় মহাজনের হাত ধরে মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের তৃণমূলের প্রাক্তন সভাধিপতি বৈদ্যনাথ ঘোষ সহ প্রায় দেড়শো জন কর্মী সমর্থক বিজেপিতে যোগদান করে । যাদের মধ্যে তৃণমূলের মুসলিম কর্মীরাও রয়েছে বলে দাবি করছে বিজেপি ।।

