ইসলামি সন্ত্রাসবাদের কারনে পাকিস্তানের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য হয়েছে ভারত । এর মধ্যে কখনও আকস্মিক আক্রমণ, সীমান্ত রক্ষা, তবে বেশিরভাগই সীমানার ওপার থেকে আসা ইসলামি সন্ত্রাসীদের নাশকতার কারনে দুই দেশের সীমান্ত রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বারবার । তবে প্রতিবারই লজ্জাজনক পরাজয়ের মুখে পড়তে হয় ইসলামি সন্ত্রাসবাদের আঁতুরঘর পাকিস্তানকে । বিশেষ করে এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা। গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে ২৫ জন হিন্দু পর্যটককে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীরা হত্যার প্রথম প্রতিশোধ আজ বুধবার ভোর রাতে পিওকে-তে ৯ টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে মিসাইল হামলা চালিয়ে নিয়েছে ভারত।
তার আগে একাধিকবার যুদ্ধে জড়িয়েছে দু’দেশ । ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তারপর থেকে দুটি দেশের মধ্যে বিভিন্ন যুদ্ধ হয়। তারমধ্যে অনেক যুদ্ধই কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে। জেনে নিন এযাবৎ কতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল :-
১৯৪৭ সালের যুদ্ধ :
ভারত ভাগের পর কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সর্বপ্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পাকিস্তান কাশ্মীরে হামলা চালায়। এতে শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। তবে, ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর অপদার্থতার কারনে কাশ্মীর দুই ভাগে বিভক্ত হয় । ভারত যুদ্ধে জিতেও কাশ্মীরের বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয় পাকিস্তান । গিলগিট-বালুচিস্তান অঞ্চলও তারা দখল করে নেয় ।
কচ্ছ যুদ্ধ:
১৯৫৬ সালে দ্বন্দ্বটির সূচনা হয়। পরে ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষীরা ভারত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে পাহারা দিতে শুরু করে। ১৯৬৫ সালের ৮ এপ্রিল উভয় দেশই ‘কচ্ছ’ অঞ্চলে একে অপরের সীমান্ত চৌকির ওপর আক্রমণ চালায়। প্রথমে শুধু উভয় দেশের সীমান্ত পুলিশরা এই সংঘর্ষে জড়িত হয়। পরে খুব দ্রুত উভয় দেশের সেনাবাহিনীও জড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালের জুনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন দু’দেশকে সংঘর্ষ বন্ধ করতে রাজি করান। তিনি বিরোধটির নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। ১৯৬৮ সালে ট্রাইব্যুনালের রায়ে পাকিস্তান দাবিকৃত ৩,৫০০ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার ভূমি লাভ করে।
কার্গিল যুদ্ধ :
১৯৯৯ সালের মে-জুলাই মাসে কাশ্মীরের কার্গিল জেলায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি সেনা ও সন্ত্রাসী ইসলামি গোষ্ঠীগুলি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের কার্গিল সেক্টরে অনুপ্রবেশ করে। তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ লাইন ব্যাহত করতে কৌশলগত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ভারত অনুপ্রবেশকারীদের হঠাতে ‘অপারেশন বিজয়’ শুরু করে। তীব্র লড়াই হয়। কয়েক সপ্তাহ পর ভারত নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে। ভারত ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসের মধ্যে হারানো বেশিরভাগ এলাকা পুনরুদ্ধার করে। যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে এবার কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি।এই যুদ্ধে ভারতের কৌশলগত বিজয় হয় এবং এই অঞ্চলে স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধার করে। নিয়ন্ত্রণ রেখা লঙ্ঘনের জন্য পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে।
পুলওয়ামা সন্ত্রাসী হামলা :
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ জন ভারতীয় সেনা শহীদ হন৷ এরপর ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেয়। পাকিস্তানের বিমান বাহিনী পাল্টা জবাব দেয়, ফলে একটি সংক্ষিপ্ত বিমান যুদ্ধ হয়। কিন্তু পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করতে গিয়ে একজন ভারতীয় পাইলট আটক হন। পরে অবশ্য তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান । ফলে উত্তেজনা প্রশমিত হয়। এই ঘটনার প্রভাব সেভাবে আঞ্চলিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি। উভয় পক্ষই বিজয় দাবি করে।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সংঘাত ও উত্তেজনা
সিয়াচেন সংঘাত (১৯৮৪)
ভারত ১৯৮৪ সালে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিয়াচেন হিমবাহে (এটি বিশ্বের উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র) দুই দেশই সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে। এখনো বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ঘটে, তবে কোনো বড় যুদ্ধ হয়নি। হিমবাহের বেশিরভাগ অংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সীমান্ত পেরিয়ে সংঘর্ষ
নিয়ন্ত্রণ রেখায় ঘন ঘন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন, বিশেষ করে ২০০০ এবং ২০১০–এর দশকে আর্টিলারি (ভারী গোলা) ও হালকা অস্ত্রের গোলাগুলি হয়। উত্তেজনার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির মধ্যে রয়েছে ২০১৬ সালের উরি হামলা এবং ২০১৯ সালের বালাকোট বিমান হামলা।
২০০১–০২ সালের অচলাবস্থা: ২০০১ সালে ভারতের জাতীয় সংসদে সন্ত্রাসী হামলা হয়। এই হামলার জন্য পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও জয়শ-ই-মহাম্মদকে দায়ী করে ভারত। এই হামলায় এক জন সাধারণ নাগরিকসহ বারো জনের মৃত্যু হয়।
এই ঘটনার পর উভয় দেশ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে। কূটনৈতিক চাপে ১০ মাসের অচলাবস্থার অবসান ঘটে এবং যুদ্ধ এড়ানো যায়।
পহেলগামে হিন্দু নরসংহার ও অপারেশন সিঁন্দুর :
সবশেষে গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসী হামলার পর নয়াদিল্লিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পরিচালিত করে । এই হামলার উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে বেছে বেছে হিন্দু নরসংহার করে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীরা । পাকিস্তান পরিচালিত এই সন্ত্রাসী হামলায় পূর্ণ সহযোগিতা করে পহেলগামের স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন । ভারত প্রথমে পাকিস্তান পন্থী ওই বিশ্বাসঘাতকদের চিহ্নিত করে কঠোর পদক্ষেপ নেয় । এরপর আজ ভোররাতে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের একাধিক শহরে মিসাইল হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে । উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সন্ত্রাসীরা ঘাঁটিগুলি করেছিল হয় মসজিদে, নচেৎ মাদ্রাসায় ।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধের মূলে হল জম্মু-কাশ্মীরের দখল । এক্ষেত্রে জম্মু-কাশ্মীরের মুসলিমদের ধর্মীয় উসকানি দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে পাকিস্তান । পাকিস্তানপন্থী কাশ্মীরের মুসলিমরাই এখন ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু ! তারা পাকিস্তানি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করে আসছে । যেকারণে কাশ্মীর সমস্যা ক্রমেই অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে । কাশ্মীর নিয়ে
উত্তেজনার মধ্যে ১৯৯৮ সালে উভয় দেশ পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এতে সংঘাতের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। উভয়ই পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে এলেও ছায়াযুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ দিন দিন বাড়ছে। এই বিরোধ ও সংঘাত নিরসনে একাধিকবার চেষ্টা হয়েছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে লাহোর ঘোষণা (১৯৯৯) এবং আগ্রা শীর্ষ সম্মেলনের (২০০১) মতো শান্তি উদ্যোগগুলো অন্যতম। তবে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বারবার সন্ত্রাসী হামলার মতো ঘটনার কারণে সব উদ্যোগ বারবার ভেস্তে গেছে।
২০১৯ সালের সংকটের পর থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনা না হওয়ায় দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও এখন বেশ দুর্বল। ২০১৯ সালে ভারত জম্মু ও কাশ্মীরের ৩৫(এ) এবং ৩৭০ ধারা বাতিল করে । যার পর পাকিস্তানি সম্পর্ক আরও জটিল করে তোলে । ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে থাকে । এই সমস্যা চিরতরে নিরসনের জন্য পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের দখল নেওয়া ভারতের জন্য খুব জরুরি হয়ে পড়েছে৷ পাশাপাশি পাকিস্তান অধিকৃত গিলগিট- বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাসবাদকে নির্মুল করার জন্য।।