ভারতীয় ইতিহাসকে বিকৃত করে উপস্থাপন করার বিষয়ে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের জুড়ি মেলা ভার । জহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের নজরে মুঘল শাসক ‘লম্পট’ আকবর ছিল… “দ্য গ্রেট” । বহু হিন্দু রাজার স্ত্রী ও কন্যার সম্ভ্রম নষ্ট করেছে ওই লম্পট মুঘল শাসক । কিন্তু ইসলামপন্থী জহরলাল নেহেরু ও কট্টর ইসলামি এবং মাদ্রাসার ছাত্র আবুল কালাম আজাদরা সেসমস্ত কাহিনী পরিকল্পিত ভাবে ঢেকে গিয়ে লম্পট আকবরকে মহিমান্বিত করে গেছে ইতিহাসের পাতায় । এমনকি দিল্লিতে সড়কপথের নামকরণ পর্যন্ত করেছে হানাদার আকবরের নামে….যার নাম ‘আকবর রোড’ ।
আকবরের লালসার হাত থেকে রেহাই পায়নি মধ্যপ্রদেশের গণ্ডোয়ানা রাজ্যের হিন্দু রাজপরিবারের মেয়েরাও । গণ্ডোয়ানা রাজ্যের ৩৩ বছর বয়সী সুন্দরী বিধবা রাণী দূর্গাবতী, তাঁর ২৮ বছর বয়সী বোন কলাবতী, নাবালিকা পালিত কন্যা এবং আশ্রীতা পুরগড়া রাজ্যের ১৬ বর্ষীয়া রাজকুমারীর সৌন্দর্য এবং রূপে আকৃষ্ট হয় নারী লোলুপ আকবর । রাণী দূর্গাবতী তাঁর ১৮ বর্ষীয় পুত্রের বিবাহ পুরগড়া রাজ্যের ১৬ বর্ষীয় রাজকুমারীর সাথে দেওয়ার জন্য ঠিক করেন । কিন্তু পুরগড়ার রাজা আকবরের ভয়ে নিজ রাজ্যে বিবাহের অনুষ্ঠান করতে সাহস পায়নি। কারণ এর আগে থেকেই রাজকুমারীর উপর আকবরের কুদৃষ্টি ছিল,আকবর শুধু রাজকুমারীর ১৬/১৭ বছর বয়স হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল ।
সেই কারনে পুরগড়ার রাজা কন্যার বিবাহের অনুষ্ঠান গণ্ডোয়ানার রাজধানী কাটঙ্গীতে আয়োজন করার কথা বললে রাণী দূর্গাবতী সহমত হন। বিবাহের কিছুদিন আগেই পুরগড়ার রাজা রাজকুমারীকে লুকিয়ে কাটঙ্গীতে পাঠিয়ে দেন । কিন্তু এই খবর মুসলমান পীর,ফকিরের মাধ্যমে আকবর জানতে পারে । প্রসঙ্গত,তখন পীর,ফকীররা আকবরের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতো । এই খবর পেয়ে আকবর ১৫৬৪ খৃষ্টাব্দে গণ্ডোয়ানা রাজ্য আক্রমণ করতে সেনাপতি আসফ খাঁর নেতৃত্বে ৫০,০০০ অশ্বারোহী ও অন্যান্য পদাতিক, হস্তি বাহিনী । সেই সময় গণ্ডোয়ানা রাজ্য যথেষ্ট শক্তিশালী এবং অনেক যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিল । তাই সরাসরি যুদ্ধে টিকতে পারবে না বলে ছলনার আশ্রয় নেয় মুঘলরা । পীর- ফকির দের মাধ্যমে রাজধানী কাটঙ্গী দুর্গে মিথ্যা প্রচার করিয়ে দেয় যে গণ্ডোয়ানা রাজ্যের মন্ডলাতে অবস্থিত দুর্গ আকবরের বাহিনী ধ্বংস করেছে। এতে রাণী দুর্গাবতী ঘাবড়ে গেলেও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন । উল্লেখ্য,এর আগে রাণী দুর্গাবতী ৫১ বার বিভিন্ন মুসলিম শাসক ও মুঘলদের সাথে যুদ্ধ করেছেন এবং প্রত্যেকবারই বিজয়ী হন। তাই এবার ছল চাতুরীর আশ্রয় নেয় আকবর এবং দু’একদিনের মধ্যেই কাটঙ্গী দুর্গ আচমকা আক্রমণ করে আকবরের বাহিনী । শুধু ২০,০০০ সৈন্য নিয়ে রাণী দূর্গাবতী এবং তার পুত্র আকবরের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ শুরু করেন । কারণ কম সময়ের জন্য অন্যান্য দূর্গ থেকে সেনা এনে একত্রিত করতে পারেননি তিনি । হঠাৎ আক্রমণ এবং মণ্ডলা দুর্গের ধ্বংস হওয়ার মিথ্যে প্রচারের জন্য মণ্ডলা দূর্গের সেনাদেরও একত্রিত করতে না পারায় বেশ কয়েক দিন ধরে প্রবলভাবে যুদ্ধ করেও রাণী পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে বন্দী হওয়ার আগে আত্মহত্যা করেন, যাতে মুঘলদের হাতে ধর্ষিতা না হতে হয় ।
এই যুদ্ধের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথের রচিত ইতিহাসের পাতায় । যুদ্ধের বিবরণে জানা যায় যে রাণী দূর্গাবতী আকবরের সেনাদের দুটো দলকে প্রথম দুদিন একদম খতম করে দিয়েছিলেন । রাণী ভেবেছিলেন যুদ্ধে তাঁর বিজয় সম্পন্ন । কিন্তু এটা ছিল আকবরের নেহাতই চালাকি । এমতাবস্থায় রাণীর এক সর্দারের বিশ্বাসঘাতকতা এবং আকবরের সেনাপতি আসাফ খাঁ নতুন এক দল নিয়ে তৃতীয় দিনে হঠাৎ আক্রমণ করে। তখন অগোছালো অবস্থায় রাণী তাড়াতাড়ি সেনা নিয়ে আক্রমণ শুরু করে, কিন্তু নতুন সেনার সামনে কম এবং ক্লান্ত সেনা নিয়ে বেশি সময় লড়াই করতে পারেননি রাণী । রাণীর পুত্র বীরনারায়ণ আহত হয়ে চিতরগড় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ লিখেছেন,এই যুদ্ধের শেষে ৫০০০ -এর বেশি মহিলা ছিল । এরা যুদ্ধের পূর্বেই দূর্গের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন । ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের ইজ্জত রক্ষার্থে আগুনে ঝাপ দিয়ে এবং বিষ পান করেন সকলে । লক্ষ লক্ষ হিন্দু গোঁণ্ড আদিবাসীকে আকবরের সেনা নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রমে রাণী দূর্গাবতীর বোন কমলাবতী এবং ১৭ বর্ষীয় পুরগড়া রাজ্যের রাজকুমারী ( রাণী দুর্গাবতীর পুত্রের সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল) আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার সময় মুঘল সেনাপতির হাতে ধরা পড়ে যান এবং সেনাপতি তাদেরকে আকবরকে তাদের ভেট করে । আকবর এঁদের যৌনদাসী বানায়। ভিনসেন্ট স্মিথ আরও লিখেছেন যে এই যুদ্ধের নৃশংসতা সমস্ত ক্রুর রাজাদেরকেও হার মানাবে। কারণ মুঘল সেনারা রাণীর পরাজিত সেনা সহ সমস্ত সাধারণ মানুষদের হত্যা করে আনন্দল্লাস করেছিল। শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী পুরুষ কেউ রেহাই পায়নি।নারীদের নিয়ে মুঘল সেনারা ধর্ষণের উৎসব করেছিল।
রানী দুর্গাবতী (1524-2024) : মহোবার বিখ্যাত চান্দেলা রাজবংশের বংশধর এবং গড়-কাটাঙ্গার গোন্ড রাজ্যের রানী, অত্যন্ত সাহস ও নেতৃত্বের সাথে মুঘল সাম্রাজ্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন। গন্ড উপজাতি একটি বিশিষ্ট মধ্য ভারতের উপজাতিরা তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্য পরিচিত, রানি দুর্গাবতী, তার সময়ের অনেক নারীর মতো, শত্রুর হাতে না পড়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা বেছে নিয়েছিলেন । কথিত আছে দুর্গাষ্টমীর দিন তার জন্ম, পিতামাতা হিন্দু দেবী দুর্গার নামানুসারে তার নাম রাখেন দুর্গাবতী।
দুর্গাবতী উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বান্দা জেলায় অবস্থিত মেডি ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ কালিঞ্জারে ১৫২৪ সালের ৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রাথার রাজা সালবাহান এবং মা মহোবার । বিখ্যাত চান্দেলদের বংশোদ্ভূত যিনি খাজুরাহো মন্দিরগুলি তৈরি করেছিলেন এবং অতীতে মাহমুদ গজনীর আক্রমণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৮ বছর বয়সে, তিনি গাড়া-কাটাঙ্গার গোন্ড রাজা সংগ্রাম শাহের পুত্র দলপত শাহের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যা দুটি রাজপরিবারের মধ্যে একটি মৈত্রীকে শক্তিশালী করে।
তৈমুরের আক্রমণের (১৩৯৮) পরে মধ্য ভারতে গড়হা -কাটাঙ্গার ছোট রাজ্যের আবির্ভাব ঘটে, যখন এই অঞ্চলের দুর্বল রাজবংশের শাসন রাজা যাদভ্রাই দ্বারা পরাজিত হয়েছিল । রাজ্যের নামটি জবলপুর শহরের ৪ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ‘গড়া’ নামক প্রধান শহর এবং ‘কাটাঙ্গা’ নামক একটি গ্রাম থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।
দলপত শাহ ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন এবং উত্তরাধিকারী হিসেবে নাবালক পুত্র বীর নারায়ণকে রেখে যান। রানী দুর্গাবতী বীর নারায়ণকে সিংহাসনে বসান এবং তিনি সরকারের লাগাম নিজের হাতে তুলে নেন । তাকে দুইজন মন্ত্রী, অধর কায়স্থ এবং মান ব্রাহ্মণ সাহায্য করেছিলেন। রানী দুর্গাবতী রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন এবং এটিকে সমৃদ্ধির উচ্চ স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তার জনগণের সুবিধার জন্য রানিতাল, চেরিতাল এবং আধারতালের মতো জলাধার নির্মাণ করেছিলেন। তিনি শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং আচার্য বিথলনাথকে গড়ায় পুষ্টিমার্গ ধর্মের একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিয়েছিলেন।
রানী দুর্গাবতী তার রাজ্যের সীমানা সুসংহত করেছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ দমন করতে তার সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার রাজ্য পূর্ব থেকে পশ্চিমে ৩০০ মাইল এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে ১৬০ মাইল বিস্তৃত ছিল। একটি সমসাময়িক ফার্সি সূত্র অনুসারে, তারিখ-ই-ফিরিস্তা , দুর্গাবতী মালওয়ার শাসক বাজ বাহাদুরকে বিতাড়িত করেছিলেন,যে ১৫৫৫ থেকে ১৫৬০ সালের মধ্যে তার রাজ্য আক্রমণ করেছিল ।
কারা-মানিকপুরের মুঘল গভর্নর, আসাফ খান, ১৫৬৪ সালে রানীর রাজ্যে সম্পূর্ণরূপে বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ শুরু করে । আসফ খান একটি বিশাল রাজকীয় সেনাবাহিনী নিয়ে গড়-কাটাঙ্গায় অগ্রসর হয় এবং দামোহ পৌঁছায় । দুর্গাবতী তার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে মুঘলদের পরাজিত করতে এবং অন্তত তিনবার পিছু হঠাতে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। যাইহোক, মুঘলরা ১০,০০০ অশ্বারোহী, পদাতিক এবং আর্টিলারি সমন্বিত একটি শক্তিশালী দল নিয়ে পুনরায় সংগঠিত হয় এবং রাণীর বাহিনীকে পরাস্ত করে।
রানী লড়াই চালিয়ে যান যতক্ষণ না দুটি তীর তাকে আঘাত করে, একটি তার ডান কাঁধে এবং অন্যটি তার ঘাড়ে। তিনি তীর দুটি টেনে বের করেন কিন্তু অজ্ঞান হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফেরার পর তিনি বুঝতে পারেন যে আর তার পক্ষে লড়াই করা সম্ভব হবে না । তিনি তার হাতি চালক অধর বাঘেলাকে তার ছুরি দিয়ে তাকে হত্যা করতে বলেছিলেন। বাঘেলা প্রত্যাখ্যান করেন। পরিবর্তে রাণীকে তিনি নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। রাণী বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা বেশিদূর যেতে পারবেন না এবং শীঘ্রই শত্রুর হাতে ধরা পড়ে যাবেন । এরপর রাণী তাঁর ছোরা বের করে তার হৃদয়ে আমূল বসিয়ে দেন । এইভাবে,১৫৬৪ সালের ২৪ জুন হিন্দু বীরাঙ্গনা রাণী দুর্গাবতী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । যিনি অসম্মানের পরিবর্তে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন। জব্বলপুর থেকে প্রায় ১২ মাইল দূরে একটি সরু পাহাড়ী গিরিপথে রাণীর লোকেরা তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ।
রানীর সাথে মুঘলদের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনাটি আবুল ফজল, আকবরের ইতিহাসকার এবং অন্যান্য ফার্সি লেখকদের দ্বারাও নথিভুক্ত করা হয়েছিল। আবুল ফজল দুর্গাবতী সম্পর্কে লিখেছেন যে তিনি ছিলেন সৌন্দর্য, করুণা এবং পুরুষসুলভ সাহস ও বীরত্বের সংমিশ্রণ। দুর্গাবতীর গল্পটিও বহু বছর পরে ব্রিটিশ কর্নেল, স্লেমান দ্বারা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, যিনি রানিকে গড়-কাটাঙ্গা শাসনকারী সমস্ত সার্বভৌম শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত বলে ভূষিত বলেছিলেন।
জবলপুরে যেখানে রাণী মৃত্যু বরণ করেছিলেন সেই স্থানেই রানী দুর্গাবতীর স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছে। প্রতি বছর ২৪ জুন এখানে একটি অনুষ্ঠান হয়, যা রাণীর সম্মানে ‘বালিদান দিবস’ বা শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হয়। ১৯৮৩ সালে জবলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে রানি দুর্গাবতী বিশ্ববিদ্যালয় করা হয় এবং তাঁর নামে একটি জাদুঘর নামকরণ করা হয়। ১৯৮৮ সালে রাণীর সম্মানে একটি ডাকটিকিট জারি করা হয়েছিল । ২০১৮ সালে, ভারতীয় কোস্ট গার্ড বিশাখাপত্তনমে তার জেলা সদর দফতরে ‘ICGS রানি দুর্গাবতী’ নামে তৃতীয় ইনশোর প্যাট্রোল ভেসেল (IPV) কমিশন গঠন করে । যাইহোক, রাণীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি হল মানুষের সম্মিলিত স্মৃতি, যেখানে তিনি মহান সম্মানের সাথে জায়গা পেয়েছেন। তাঁর জীবন কাহিনী একটি কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে যা গান এবং গল্পের থিম তৈরি করে, যার মাধ্যমে তিনি প্রতিদিন মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকেন । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২৩ সালের ২৪ শে জুন ধ্যপ্রদেশের শাহদোলে রানী দুর্গাবতীকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে রাণী দুর্গাবতীকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।।