এইদিন ওয়েবডেস্ক,২০ মে : ভিয়েতনাম, অ্যাঙ্গোলা, জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা নিয়ে চর্চা করলেও আজকের দিনে বাংলাদেশের খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে যে হিন্দু নরসংহার চলেছিল তা ভুলে গেছে আত্মবিস্মৃত হিন্দু বাঙালী ৷ ১৯৭১ সালের ২০ মে পাকিস্তানি হানাদার ও বাংলাদেশী মৌলবাদীরা চুকনগরের ১০,০০০ থেকে ১২,০০০ হিন্দুকে নির্বিচারে খুন করেছিল । হিন্দুদের রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল চুকনগরের মাটি । পাশাপাশি চলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি লুট,নির্যাতন ও নির্বিচারে ধর্ষণ । পৃথিবীর ইতিহাসে একদিনে এতবড় পৈশাচিক গনহত্যার নজির নেই,যেটা আজ থেকে ৪২ বছর আগে বাংলাদেশের চুকনগরে হয়েছিল ।
পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট শহরের নিকটবর্তী ঘোজাডাঙ্গা সীমান্ত থেকে মাত্র ৪৪ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর । এক সময়ে হিন্দু অধ্যুষিত ছিল এই এলাটি । পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশে রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠার পর খুলনাকে হিন্দু শুণ্য করতে উঠেপড়ে লাগে । হিন্দুদের উপর সংগঠিত অত্যাচার হিংস্রতর রূপ নেয় । জামায়াতের অন্যতম শীর্ষনেতা মওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে ১৯৭১ সালের ৫ মে । তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল মুসলিম লীগ । তাদের মিলিত আক্রমণে খুলনা শহর সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয় । রাজাকাররা বেছে বেছে হিন্দুদের ধরে এনে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে’ নিয়ে এসে অমানবিক অত্যাচার চালায়, হত্যা করে, হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট ও মহিলাদের নির্বিচারে ধর্ষণ করতে শুরু করে । এরপর ১৫ মে খবর ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী খান সেনারা আসছে হিন্দুদের উৎখাত করতে । ফলে ভয়ের মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে যায় । নিজেদের প্রাণ ও পরিবারের মহিলাদের সম্ভ্রম বাঁচাতে খুলনার বাগেরহাট, রামপাল,মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনা, ফরিদপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার হিন্দু দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয় ।
ভারতে যাবার জন্যে তারা ট্রানজিট হিসেবে বেছে নেন ডুমুরিয়ার চুকনগরকে । ভীত সন্ত্রস্ত হিন্দুরা নদী পেরিয়ে জড়ো হয় চুকনগর বাজার, পাতখোলা ও ভদ্রা নদীর চারপাশে । তাদের লক্ষ্য ছিল সাতক্ষীরার সড়ক ধরে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢোকা । কিন্তু পথে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে তাদের আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় না ।
ফলে বিশাল সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভারত পালানোর জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকে । এদিকে খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবে কাতর হয়ে ওঠে তারা । পরিবারের শিশু ও মহিলাদের কথা ভেবে ১৯ মে রাতে সবাই চুনগরে এসে পৌঁছান। পরদিন সকালে সাতক্ষীরা এবং কলারোয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার জন্য লক্ষাধিক হিন্দু চুকনগরে সমবেত হয়ে যায় ।
কিন্তু তারা কল্পনাও করেনি যে পরের দিন কি নৃশংস ঘটনার মুখোমুখি হতে চলেছেন তারা । অবশেষে এসে যায় ১৯৭১ সালের ২০ মে-এর সেই কালো দিনটি । বেলা ১১ টার সময় একটি ট্রাক ও একটি জিপ গাড়িতে পাকিস্তানি হানাদার ও বাংলাদেশি ইসলামি মৌলবাদিদের একটা দল চুকনগরে আসে । পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ হায়াত তাদের হিন্দুদের উপর নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয় । ওইদিন বিকেল তিনটে পর্যন্ত নির্বিচারে গোলাগুলি চলে । মৃতদেহগুলো নদীতে ফেলে দেওয়া হয় । যারা প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের গুলি করে হত্যা করা হয় । আটলিয়া ইউনিয়নের পাতাখোলার বিল থেকে ভদ্রা নদী এবং সাতক্ষীরা রোড থেকে ঘ্যাংরাইল নদী পর্যন্ত যতদূর দেখা যায় শুধু লাশ আর লাশ । রক্তে লাল হয়ে ওঠে নদীর জল । তবে সেদিন ঠিক কত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশ সরকারের রেকর্ডে নেই । অনুমান করা হয় ওইদিন ১০,০০০ থেকে ১২,০০০ হিন্দুকে হত্যা করেছিল পাকিস্থানি উর্দুভাষী হানাদার আর বাংলাদেশের বাংলাভাষী রাজাকাররা । গণহত্যার পর নদীতে লাশ আর রক্তের স্রোত দেখে আঁতকে উঠেছিলো জীবিত থাকা অবশিষ্ট হিন্দুরা ।
নরসংহারের পরে ওই দিন সন্ধ্যা নাগাদ নদী থেকে লাশ উদ্ধার শুরু হয় । দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় মুসলিমদের ৪২ জনের একটি দলকে । লাশ পিছু ৫০ পয়সা করে চুক্তি হয় । তাতেও তারা রাজি হয়ে যায় । কারন ভারতে পালানোর প্রস্তুতি নিয়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছিল নিহত হিন্দুরা । ফলে তাদের পকেটে ছিল প্রচুর টাকা আর ব্যাগের মধ্যে ছিল সোনার গহনা । নদী থেকে দেহ উদ্ধারের পাশাপাশি ওই সমস্ত টাকা আর গহনা লুটপাট চালায় উদ্ধারকারী দলটি । জানা যায়, ২৪ তারিখে দুপুর পর্যন্ত ৪,০০০ লাশ উদ্ধারের পর শেষ পর্যন্ত তারা হাল ছেড়ে দেয় । তখনো নদী, পুকুর, ডোবা, জলায় হাজার হাজার লাশ ভাসছে ।
পরবর্তী সময়ে চুকনগরে হিন্দু নরসংহারের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিক ফজলুল বারী জনকণ্ঠের এক নিবন্ধে লিখেছিলেন,’লাশের উপর লাশ, মায়ের কোলে শিশুর লাশ, স্বামীকে বাঁচাতে স্ত্রী জড়িয়ে ধরেছিল,বাবা মেয়েকে বাঁচাতে জড়িয়ে ধরেছিল,মুহূর্তেই সবাই লাশ হয়ে যায় । ভদ্রা নদীর পানিতে বয় রক্তের বহর, ভদ্রা নদী হয়ে যায় লাশের নদী ।’
প্রাণে বেঁচে ফেরা হিন্দুদের কথায়,’ওরা পশুপাখির মতো গুলি করে মানুষ মেরেছে, উন্মত্ত মাতালের মতো গুলি ছুড়েছে। অসহায় হয়ে, মাটিতে শুয়ে সে দৃশ্য দেখতে হয়েছে আমাদের,বরাত জোরে বেঁচে গেছি। শুধু এই নয়, সৈন্যদের নির্বিচার গুলি থেকে বাঁচতে বহু মানুষ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচার আশায়। নদীতেও নির্বিচার গুলি চালায় উন্মত্ত সৈন্যরা- রক্তাক্ত হয়ে ওঠে নদীর জল। চারদিকে তখন কেবল লাশের স্তূপ, রক্তের স্রোত, যা গড়িয়ে নামতে থাকে নদীর জলে। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের আর্তনাদে ।’
অথচ এত বড় নরসংহারকে সুপরিকল্পিতভাবে চেপে যায় বাংলাদেশ সরকার । নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ খুলনার চুকনগরে হিন্দু নরসংহারের বিষয়ে কিছুই জানতো না । ভারতের তথাকথিত সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলি ও বুদ্ধিজীবীরা সবকিছু জেনে শুনেও চোখ কান বুজে থেকেছিল । ফলে এদেশের মানুষ খুলনার চুকনগরে হিন্দু নরসংহারের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি । ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস মানুষ জানতে পারে ১৯৯৩ সালের পর থেকে । কারন ওই বছরেই গঠিত হয় ‘চুকনগর গণ হত্যা ৭১ স্মৃতি রক্ষা পরিষদ’। তারপর থেকে চুকনগরে নারকীয় গনহত্যায় নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা জানাতে শুরু করেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ।
বাংলাদেশের খুলনার চুকনগরে হিন্দু নরসংহারের ঘটনায় নিহতদের প্রতি আজ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এরাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী । আজ শনিবার তিনি তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন,’
১৯৭১ সালের ২০শে মে, খুলনার চুকনগরে পাকিস্তানী হানাদাররা বাংলাদেশের মৌলবাদীদের নিয়ে একযোগে দশ হাজার হিন্দুদের হত্যা করেছিল। পৃথিবীতে একদিনে এতবড় পৈশাচিক গণহত্যা কখনও হয়নি। চুকনগর গণহত্যায় আত্ম বলিদানকারী সকল শহীদদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি ।’।