শ্যামসুন্দর ঘোষ,কাটোয়া(পূর্ব বর্ধমান),১৯ অক্টোবর : স্বপ্নাদেশ পেয়ে পৈতৃক ভিটায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেবী কালীকে । দেবীর নির্দেশ মত নির্মান করেছিলেন মন্দির । পূজোয় ছিল না কোনো নিষ্ঠার অভাব । দেবী নির্দেশিত রীতিনীতি মেনেই হত বাৎসরিক পূজো । কিন্তু কট্টরপন্থীদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে পারেননি দেবী । এক প্রকার বাধ্য হয়েই পরিবার নিয়ে দেশত্যাগী হতে হয়েছিল বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা পেশায় ব্যবসায়ী মধুসুদন চক্রবর্তীকে । চলে আসেন ভারতে । পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া থানার দাঁইহাট এলাকার পাতাইহাটে এসে গড়ে তোলেন নতুন ঠিকানা । আসুরিক শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে না পারলেও আজও কুলদেবীকে ভোলেনি চক্রবর্তী পরিবার । পুরনো সেই রীতিনীতি মেনেই কুলদেবীর পূজো করে আসছেন মধুসুদন বাবুর উত্তরসূরীরা ।
পরিবারের সদস্য সন্তু চক্রবর্তী, তন্ময় চক্রবর্তী, শ্রাবনী চ্যাট্টার্জ্জীরা বলেন,’আমাদের দাদু মধুসুদন চক্রবর্তী খুবই ধার্মিক প্রকৃতির ছিলেন । সময়টা তখন ১৯০৬ সাল । মাস দুয়েক পরেই কালীপূজো । একরাতে স্বপ্নাদেশ পান দাদু । ঘুমের মধ্যেই সাক্ষাৎ দেবী দর্শন দিয়ে বলেন ‘পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি আর সুরক্ষার জন্য আমার পূজো কর’ । দেবীর কথামত বাড়ির পূর্ব দিকে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দাদু । পূজোয় কিছু বিধিনিষেধের মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছিলেন দেবী । দেবীর নির্দেশ মত ১৬ পোয়া দৈর্ঘের প্রতিমা নির্মান হত । বৈষ্ণব মতে পূজো হত দেবীর । পূজোয় পশুবলি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল । কালীপূজোর আগের দিন পরিবারের সকলকে উপবাস থাকতে হত । বাৎসরিক পূজোর রাতে দেবীকে দেওয়া হত ৫১ টি নৈবেদ্য । পরিজনসহ ১০১ জন প্রতিবেশীকে পুজোয় নিমন্ত্রণ করে ভোগ খাওয়ানো হত । নির্দেশ মত নিজেদের জমির ফসল দিয়েই দেবীর ভোগ নিবেদন করা হত । দেবীর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন দাদু ও পরিবারের বাকি লোকজন । দাদুর প্রচুর শিষ্য ছিল । তাঁরা সকলেই পূজোর দিন আমাদের বাড়িতে আসতেন । কালীপূজোর দিনে জমজমাট হয়ে উঠতো গোটা গ্রাম ।’ তাঁরা বলেন,’কিন্তু মাত্র কয়েকটা বছর পূজো পরিচালনা করতে পেরেছিলেন দাদু । তারপরেই তাঁকে সপরিবারে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয় ।’
চক্রবর্তী পরিবারের অনান্য সদস্য তরুন চক্রবর্তী, সন্দীপ চক্রবর্তী, অমৃতা মুখাজ্জী, বিশ্বজিত চক্রবর্তীরা বলেন,’শুনেছি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল আমাদের পরিবার । দাদুর রমরমা ব্যবসা । ঘরবাড়ি, জমিজমা, পুকুর,গোয়াল ভর্তি গরু । কি ছিল না আমাদের । কিন্তু পরিবারের প্রাণ বাঁচাতে সব কিছু খুবই স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন আমাদের দাদু ।’
পরিবার সুত্রে জানা যায়,তখনও ভারত স্বাধীন হয়নি । দেশ জুড়ে অশান্ত পরিবেশ । ইংরেজদের অত্যাচারের পাশাপাশি দ্রুত হারে বাড়ছে কট্টরপন্থীদের সংখ্যা । প্রতি দিনই কোথাও না কোথা থেকে আসছে অশান্তির খবর । পাশাপাশি ঘটছে ধর্ষণ,খুন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা । এই অশান্ত পরিবেশের মাঝে তখন মধুসূদনবাবুর দুই পুত্র হরেন্দ্র ও মনীন্দ্রের জন্ম হয়ে গিয়েছে । তাই তিনি আর বাংলাদেশে থাকার ঝুঁকি নিতে পারেননি । খুঁজছিলেন নিরাপদ আশ্রয় । অবশেষে ৪০ এর দশকে তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে বর্ধমান জেলার দাঁইহাটে চলে আসেন । দাঁইহাটের পাতাইহাট মৌজায় ভিটে জমি ছাড়াও প্রচুর কৃষিজমি, পুকুর কিনে নতুন ভাবে সংসার শুরু করেন । সঙ্গে করে আনেন স্বপ্নে দেখা দেওয়া দেবী কালীকে । দেবীর নির্দেশ মতই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । তখন থেকেই পাতাইহাটের চক্রবর্তী পরিবারে কালীপূজা হয়ে আসছে ।
মধুসূদনবাবুর বংশধর বিজয়লক্ষী চক্রবর্তী, স্বপন চক্রবর্তী, তপন চক্রবর্তী, গোপাল চক্রবর্তী, গোবিন্দ চক্রবর্তী,শুক্লা চক্রবর্তীরা জানান,দিপাবলীর দুমাস আগে থাকতেই পুজো প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় । ভোগ, নৈবিদ্য প্রস্তুত করে পরিবারের মহিলা সদস্যরা । নিমন্ত্রিতদের ভোগ রাঁধার জন্য চারজন ব্রাহ্মন রাঁধুনির উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় । প্রায় দুই কুইন্টাল চালের খিচুড়ি ও পায়েস রান্না করা হয় । তাঁরা বলেন,’সময়ের সাথে আমাদের কালীপূজোয় কিছু অনুষ্ঠানের সংযোজন করা হয়েছে । যেমন, কালীপুজোর পরের দিন বিকেল ৫০ জন দুঃস্থ প্রতিবন্ধীকে নতুন বস্ত্র দান করা হয় । কিছু শুকনো খাবার দেওয়া হয় । ওই দিন সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় ধর্মীয় ও কথামৃত পাঠ অনুষ্ঠান ।’
পাতাইহাটের চক্রবর্তী পরিবারের কালীপূজো ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও চরম আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় । আশপাশের গ্রাম থেকে প্রচুর ভক্ত চক্রবর্তী পরিবারের শতাব্দী প্রাচীন কালী পুজো দেখতে আসেন । পুজো দেন তাঁরা ।।