ভারতে বর্বর আরব হানাদারদের আগমন শুরু হয় ৭১১-৭১২ খ্রিস্টাব্দে । প্রথম আরব হানাদার মুহাম্মাদ বিন কাসিম তৎকালীন রাজা দাহিরকে পরাজিত করে সিন্ধু জয় করে । দাহিরের শিরশ্ছেদ করা হয় এবং তার মাথা বসরার গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পাঠানো হয় । দাহির সিন্ধি ব্রাহ্মণ রাজবংশের শেষ শাসক ছিল এবং তারপর সিন্ধু ইসলামি খিলাফতের অংশ হয় । হানাদার মুহাম্মাদ বিন কাসিম মুলতান জয়ের পর হিন্দু গ্রাম ও শহরে ব্যাপক রক্তপাত ঘটিয়েছিল । আল হাজ্জাক শিরোনামের বায়োগ্রাফিকাল অনুসারে, দাহিরকে হত্যার পর মুহাম্মদ বিন কাসিম এক লাখ বিশ হাজার (১,২০,০০০) হিন্দুকে হত্যা করেছিল । মুহাম্মাদ বিন কাসিম ৭১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুলাই ২০ বছর বয়সে ইরাকের মসুলে মারা যায় । কাসিমের মৃত্যুর পর,৩০,০০০ হিন্দু পুরুষ এবং ২০,০০০ নারীকে কারাগারে বন্দী অবস্থায় পাওয়া যায়। এত নৃশংসতা সত্ত্বেও মুসলমানরা তাকে ন্যায় ও ন্যায্যতার ঈশ্বর বলে মনে করে ।
কাসিমের নৃশংসতার মধ্যে শিশু তক্ষকের পিতা কাসিমের বাহিনীর সাথে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন । লুটপাটকারী আরব সেনারা তক্ষকের গ্রামে পৌঁছে ব্যপক বর্বরতা চালায়। হিন্দু নারীদের ঘর থেকে টেনে বের করে আনা হয় এবং তাদের গনধর্ষণ করা হয়। তক্ষকের বাড়ির সবাই ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। তক্ষক ও তার দুই বোন ভয়ে কাঁপতে থাকে।
তক্ষকের মা পুরো পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি কিছুক্ষণ তার সন্তানদের দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন এবং মনে মনে একটা সিদ্ধান্তে নিয়ে ফেলেন । তিন সন্তানকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কেঁদেছিলেন তক্ষকের মা । তারপর ওই মহান নারী তার খাপ থেকে তলোয়ার বের করে তার দুই কন্যার শিরশ্ছেদ করে। তারপরে আরবদের দ্বারা জবাই করা গরুকে দেখান ছেলে তক্ষককে এবং শেষে তলোয়ারটি নিজের বুকে আমূল বসিয়ে দিয়ে মৃত্যু বরণ করেন ।
আট বছরের বালক তক্ষক তার মায়ের ইঙ্গিত বুঝে ফেলে । তখনই বর্বর আরব হানাদারদের নৃশংসতার যোগ্য জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ছোট্ট শিশুটি । একপলক দুই বোন আর মৃত মাকে দেখে নেয় সে । মায়ের আঁচলে শেষবারের মত চোখ মুছে নেয় । তারপর বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ক্ষেত দিয়ে দৌড়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে গিয়ে আত্মরক্ষা করে নিজের প্রাণ বাঁচায় শিশু তক্ষক ।
তারপর দেখতে দেখতে ২৫ বছর কেটে যায় । চোখে প্রতিহিংসার আগুন নিয়ে বেড়ে ওঠা তক্ষক তখন ৩৩ বছরের যুবক । ইতিমধ্যেই তিনি কনৌজের গৌরবময় গুর্জরা-প্রতিহার রাজবংশের শাসক দ্বিতীয় নাগভট্টের প্রধান দেহরক্ষীর কাজ পেয়ে গেছেন তিনি ৷ কিন্তু বছরের পর বছর কেউ তার মুখে কোনো আবেগের চিহ্ন দেখেনি। তিনি সুখী বা দুঃখী ছিলেন না। দুই বোন আর মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধের আগুনে তার চোখ সবসময় আগুনের মতো লাল থাকত।তক্ষকের বীরত্বের কাহিনি ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনীর সকলে জেনে গেছে । কারন তক্ষক তার তরবারির এক আঘাতে একটি পাগলা হাতিকে হত্যা করেছিলেন, তিনি ছিলেন সৈন্যদের জন্য আদর্শ।
কনৌজের রাজা নাগভট্ট তার অবিশ্বাস্য সাহসিকতার সাথে আরবদের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। সিন্ধু শাসক আরবরা কয়েকবার কনৌজ আক্রমণ করেছিল। কিন্তু প্রতিবারই সাহসী ক্ষত্রিয়রা তাদের তাড়িয়ে দিত। নাগভট্ট, যুদ্ধের চিরন্তন নিয়ম অনুসরণ করে, কখনও তাদের তাড়া করেননি। আর এই ন্যায়পরায়ণতা হিন্দু রাজাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠেছিল । কারন পরাজিত আরবদের প্রাণ ভিক্ষা দেওয়ায় তারা ফিরে গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে ফের হামলা চালাত । একই ভুল করতেন নাগভট্ট । বর্বর আরব হানাদারদের নির্মুল না করে তিনি শুধু তাড়িয়ে দিতেন । একারনে পনেরো বছর ধরে আরবদের বারবার আক্রমণের শিকার হতে হয় তার রাজ্যকে ।
আরব হাবাদারদের এই উৎপাত থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পেতে ফের একবাত জরুরি বৈঠক ডাকেন নাগভট্ট ।
কারন এদিকে আরব খিলাফতের সহায়তায় সিন্ধুর বিশাল বাহিনী কনৌজ আক্রমণের জন্য রওনা হয়েছে এবং সম্ভবত দুই-তিন দিনের মধ্যেই এই বাহিনী কনৌজের সীমান্তে অবস্থান করবে। মহারাজ নাগভট্ট এ বিষয়ে একটি কৌশল প্রণয়নের জন্য এই বৈঠক ডেকেছিলেন। সকল সেনাপ্রধান তাদের মতামত জানাচ্ছিলেন, তখন দেহরক্ষী তক্ষক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, মহারাজ, এবার শত্রুকে তাদের নিজস্ব কায়দায় জবাব দিতে হবে। মহারাজ তার দেহরক্ষী তক্ষককের দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন,’খুলে বলো, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।’
তক্ষক বলেন,’মহারাজ, আরব সৈন্যরা অতি বর্বর, তাদের সাথে চিরন্তন নিয়মে যুদ্ধ করে আমরা শুধু আমাদের যোদ্ধাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেব । আরবদের কায়দাতেই তাদের পরাজিত হতে হবে।’
একথা শুন্ব মহারাজের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায় । অল্প সময় ভেবস তিনি বললেন,’কিন্তু আমরা ধর্ম ও মর্যাদা ত্যাগ করতে পারি না।’
তখনতক্ষক বলেন,’যারা মর্যাদার মানে বোঝে তারাই মর্যাদা অনুসরণ করে। এরা বর্বর ধর্মান্ধ দানব মহারাজ। তাদের কাছে খুন ও ধর্ষণই ধর্ম। কিন্তু এটা আমাদের ধর্ম নয়, আমরা সাহসী। একজন রাজার একটাই দায়িত্ব, মহামান্য, আর তা হল প্রজাদের রক্ষা করা। মহারাজ, দেবাল ও মুলতানের যুদ্ধের কথা মনে রাখবেন, যখন কাসিমের বাহিনী দাহিরকে পরাজিত করার পর জনগণকে নির্যাতন করেছিল। ঈশ্বর না করুন, যদি আমরাও পরাজিত হই, আপনি ভাল করেই জানেন যে বর্বর অত্যাচারী আরবরা আমাদের নারী, শিশু এবং নিরীহ প্রজাদের সাথে কি আচরণ করবে।’
তক্ষকের মুখ থেকে একথা শুনে মহারাজ একবার পুরো সমাবেশের দিকে তাকালেন, সবাই তখন বাকরুদ্ধ হয়ে নিজের নিজের স্থানে বসে আছে । তাদের অনেকেই তক্ষকের যুক্তির সাথে সহমত পোষণ করেন ।
এরপর রাজা তার প্রধান সেনাপতি, মন্ত্রী ও তক্ষককে সঙ্গে নিয়ে গোপন বৈঠকখানার দিকে এগিয়ে গেলেন।
পরের দিন সন্ধ্যা নাগাদ, উভয় বাহিনী কনৌজের পশ্চিম সীমান্তে শিবির স্থাপন করেছিল এবং আশা করা হয়েছিল যে পরের দিন সকালে একটি ভয়াবহ যুদ্ধের সাক্ষী হবে । কিন্তু তক্ষকের রণনীতি অনুযায়ী
মধ্যরাতেই ঘটে যায় সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। আরব বাহিনী তখন তাদের শিবিরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ তক্ষকের নেতৃত্বে কনৌজের এক চতুর্থাংশ সৈন্য আরব শিবির আক্রমণ করে। আরবরা কোন হিন্দু শাসকের সাথে রাতের যুদ্ধ আশা করেনি। তারা জেগে উঠে সতর্ক হয়ে অস্ত্র তুলে নেওয়ার আগেই হাজার হাজার হানাদার সেনা খতম করে দেয় তক্ষকের বাহিনী । মা ও দুই বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধের আগুনে জ্বলা তক্ষকের ভয়ংকর রূপে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পরে হানাদাররা । ঘোড়ায় চড়ে তিনি যেখানেই যাচ্ছিলেন সেখানেই তিনি আরব হানাদার বাহিনীকর কচুকাটা করেন । হানাদারদের মৃতদেহের সারির মাঝে দাঁড়িয়ে আজ তক্ষক পরিতৃপ্ত । কারন হানাদারের রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে মা বোনদের আত্মাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান তিনি ।
ভোরের প্রথম রশ্মি ফুটতেই তখন আরব সেনাবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ খতম হয়। সকাল হতে না হতেই বাকি সেনারা পিছু হঠতে শুরু করে । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যে স্বয়ং মহারাজ নাগভট্ট তাঁর অবশিষ্ট সৈন্যসহ সেখানে প্রস্তুত ছিলেন। দুপুর নাগাদ সমগ্র আরব বাহিনীর লাশ বিছিয়ে যায় গোটা এলাকায় । বর্বরতার জোরে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখা সন্ত্রাসীদের এমন জবাব এই প্রথম ভারতে কোনো রাজা দিয়েছিল।
বিজয়ের পর মহারাজ তার সব সেনাপতির দিকে তাকালেন, কিন্তু তাদের মধ্যে তক্ষককে দেখতে পাননি । সৈন্যরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে তক্ষককে খুঁজতে শুরু করল, তখন তারা দেখল প্রায় এক হাজার আরব সৈন্যের মৃতদেহের মধ্যে তক্ষকের মৃতদেহ জ্বলজ্বল করছে । তাকে দ্রুত তুলে মহারাজার কাছে নিয়ে আসা হল। এই অপূর্ব যোদ্ধার দিকে কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থাকার পর, মহারাজ নাগভট্ট এগিয়ে এসে তক্ষকের পায়ে কাছে নিজের তলোয়ার নামিয়ে রেখে তাঁর মৃতদেহকে প্রণাম করলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে । রাজা মৃদু গলায় বলেন,’তক্ষক, তুমি ছিলে আর্যাবর্তের বীরত্বের প্রতিমূর্তি… এতদিন ভারত মাতৃভূমি রক্ষায় প্রাণ দিতে শিখেছিল, মাতৃভূমির জন্য তুমি প্রাণ নিতে শিখিয়েছ । ভারত যুগ যুগ ধরে তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।’
ইতিহাস সাক্ষী এই যুদ্ধের পর আরবরা পরবর্তী তিন শতাব্দী ভারতের দিকে তাকানোর সাহস পায়নি। তক্ষক শিখিয়েছে যে মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবন দেওয়ার মধ্যে যত না কৃতিত্বের, তার থেকে বেশি কৃতিত্বের বর্বর, পাপাচারীদের তাদের ভাষাতেই জবাব দেওয়া ।।