প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৩ নভেম্বর : চিকিৎসায় মেয়ে সুস্থ না হলেও বিশালাক্ষী রঙ্কিনীদেবী মাতার কৃপাতেই সুস্থ হয়ে উঠবে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়া মেয়ে।এমন বিশ্বাসে ভর করে সেই কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন থেকে অসুস্থ মেয়ে ঋতু মুদিকে সঙ্গে নিয়ে দেবীর মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন মা তাপসী মুদি। তাঁদের এখন ঠিকানাই হয়ে গিয়েছে পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থানার গোপিকান্তপুর গ্রামে থাকা রঙ্কিনীদেবীর মন্দির।ঘর বাড়ি সব ছেড়ে এসে দিন রাত সেখানে থেকেই মেয়ের সুস্থতার জন্য দেবীর কাছে প্রার্থনা জানিয়ে চলেছেন অসহায় মা ।এইসব কিছুকে এলাকার বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তি ও চিকিৎসকরা টেরা চোখে দেখলেও তাপসীদেবী দাবি করেছেন,তাঁর মেয়ে রঙ্কিনী দেবীর কৃপায় সুস্থতার দিকেই এগোচ্ছে ।
জামালপুরের চকদিঘী পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম গোপিকান্তপুর।এই গ্রামের এক পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ডাকাতিয়া খাল।সেই খালের পাশেই রয়েছে বিশালাক্ষী রঙ্কিনীদেবী মাতার প্রাচীন মন্দির।দেবীর প্রতি ভক্তিভাবের অন্ত নেই এলাকাবাসীর। তাঁদের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় রঙ্কিনীদেবীর মাহাত্ম্য ও নানা অলৌকিক কাহিনীর কথা।সেইসব জেনে দুর দুরান্তের বহু ভক্তও প্রতিদিন মন্দিরে পুজো দিতে আসেন।অনেকে মানতও করেন।একই ভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়া মেয়ে ঋতু কে সুস্থ করে তুলতে মা তাপসী দেবীও ভরসা রেখেছেন রঙ্কিনীদেবী মাতার উপরেই ।
গোপিকান্তপুর গ্রামের মুদি পাড়ায় বাড়ি তাপসী দেবীর।তাঁর স্বামী যাদব মুদি পেশায় খেত মজুর । দারিদ্রতাই তাঁদের নিত্য দিনের সঙ্গী।তাপসীদেবী মঙ্গলবার জানান ,তাঁর মেয়ে ঋতু ছোট থেকে সুস্থই ছিল।পড়াশুনাও করছিল গ্রামের বাণী নিকেতন রঙ্কিনী মহুলা বিদ্যালয়ে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়েই ঋতুর শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিতে শুরু করে।ওই
সময়ে ঋতুর মুখ দিয়ে লালা ঝরা শুরু হয়,কথাও জড়িয়ে যেতে থাকে। এমনকি কমতে শুরু করে দুই হাতের শক্তি ও দুই পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ।তাপসীদেবী বলেন,’তখন থেকেই চিকিৎসার জন্য ঋতুকে কোলে করে নিয়ে আমি ও আমার স্বামী বিভিন্ন জায়গার ডাক্তার বাবুর কাছে যাই।অনেক কষ্ট করে পয়সা জোগাড় করে ডাক্তার বাবুদের লিখে দেওয়া ওষুধ কিনে মেয়েকে খাইয়েও যাই।মেয়ের অনেক শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও
করান।এই ভাবে বছরের পর বছর ধৈর্য্য ধরে বর্ধমান হাসপাতাল সহ বিভিন্ন ডাক্তার বাবুর পরামর্শ মেনে সব কিছু করে যান।তা কারতে গিয়ে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের মাধ্যমে চিকিৎসা করানোর সব টাকাও শেষ হয়ে যায়।ছোট বয়স থেকে চিকিৎসা শুরু হওয়া মেয়ের বয়স এখন ১৯ শে পৌছে গেছে। কিন্তু মেয়ে সুস্থ হয় না।তাই হতাশ হয়ে চোখের জল ফেলে দিন কাটানো ছাড়া আমার কাছে আর কোন পথ ছিলনা বলে তাপসীদেবী জানান ।
কঠিন রোগে আক্রান্ত অনেকেই তো দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যায়।সেই ভরসা না রেখে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে বিশালাক্ষী রঙ্কিনীদেবীর দ্বারস্থ হবার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন ? এর উত্তরে তাপসীদেবী বলেন,’রঙ্কিনীদেবী মাতা আমায় স্বপ্নে দেখাদেন ।দেবী মা আমাকে আদেশ করেন,আমার অসুস্থ মেয়েকে সুস্থ করার জন্য আমায় মেয়েকে নিয়েই মন্দিরে পড়ে থাকতে হবে“।তাই রঙ্কিনীদেবীর আদেশ মতই এই বছরের কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন ঘর বাড়ি সব ছেড়ে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে দেবীর মন্দিরে চলে আসেন।সেই থেকে মন্দির সন্মুখের আটচালায় ঠাঁই নিয়ে দেবীর কাছে শুধুই মেয়ের সুস্থতা কামনায় দিন রাত প্রার্থনা জানিয়ে যাচ্ছেন বলে তাপসীদেবী জানান“।মন্দির চত্ত্বরে দেবীর প্রসাদ ছাড়া অন্য আর কিছু খাওয়ার তো অনুমতি নেই। তাহলে মা ও মেয়েতে মিলে খাওয়া দাওয়া কি করছেন? উত্তরে তাপসীদেবী বলেন,’চিড়ে,দেবীর ফল প্রসাদ আর দেবীর চরণামৃত ও শান্তিজল নিজেও খাচ্ছেন, মেয়েকেও তাই খাওয়াচ্ছেন“।এতদিন ধরে এইভাবে বিশালাক্ষী রঙ্কিনীদেবী মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকে মেয়ের শারীরিক সুস্থতা কি ফিরছে ?এর উত্তরে তাপসীদেবী জানান,তাঁর মেয়ে এখন আগের থেকে অনেকটা ভালো।তাঁর মেয়ে দেবীর কৃপাতেই সুস্থতার দিকেই এগোচ্ছে।দেবীমার কৃপায় মেয়ে ঋতু সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে বলেও দৃঢ় প্রত্যয়ী তাপসীদেবী । মন্দিরের সেবাইত অলক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,
“আমাদের বিশালাক্ষী রঙ্কিনীদেবী মা অত্যন্ত
জাগ্রত। দেবীর মাহাত্ম্যের কথা যাঁরা জানেন
তাঁর সবাই দেবীর কাছে মাথা নত করেন। স্বপ্নে
দেবীর নির্দেশ পেয়ে অসুস্থ মেয়ে ঋতুর সুস্থতা কামনায় তাঁর মা তাপসীদেবী দীর্ঘদিন ধরে মন্দির চত্ত্বরে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন। দেবী মা হয়তো ওই মা ও মেয়ের তাঁর প্রতি ভক্তি ও ধৈর্য্যর পরীক্ষা নিচ্ছেন।পুজারি অলক বাবু জানান ,’তিনিও বিশ্বাস করেন,দেবী মায়ের নেওয়া পরীক্ষায় পাশ করলে তাপসীদেবীর মেয়ে ঋতু সুস্থ হয়ে উঠবেই“ । অপর সেবাইত সৌমেন ঘটক বলেন,’প্রায় দু’মাস হতে চললো অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে তাঁর মা মন্দিরেই পড়ে রয়েছেন।প্রথম যেদিন মেয়েটিকে নিয়ে তাঁর মা
আসে তখন মেয়েটি হাঁটতে পারছিলনা। হামাগড়ি দিয়ে মেয়েটি মন্দিরে উঠে দেবী মাকে প্রণাম জানায়। আর দিন করেক আগে তিনি দেখেন ঋতু নামের ওই মেয়েটি তাঁর মায়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে মন্দিরে উঠছে।সবটাই দেবী মায়ের কৃপাতেই সম্ভব হচ্ছে বলে সেবাইত সৌমেন ঘটকও দাবি করেছেন ।
এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান গৌরসুন্দর মণ্ডল বলেন,দেবীর মাহত্ম্যে অসুস্থ মেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠছে কিনা এইসব নিয়ে কোন যুক্তি তক্কে তিনি যেতে চান না।কারণ প্রবাদই আছে ,“বিশ্বাসে মিলায় বস্তু- তর্কে বহু দূর’।গৌরসুন্দর বাবুও স্পষ্ট জানিয়ে দেন,তিনিও বিশ্বাস করেন দেবী বিশালাক্ষী রঙ্কিনী মাতার কৃপায় অনেক অসম্ভবই সম্ভব হতে পারে ।
যদিও জামালপুর গ্রামীণ হাসপাতলের বিএমওএইচ ঋত্তিক ঘোষ বলেন,“একজন চিকিৎসক হিসাবে তিনি এই বিষয়টিকে বিশ্বাস যোগ্য বলে মেনেনিতে পারছেন না। কারণ, এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়েছে।তার ফলে সম্ভব হচ্ছে অনেক জটিল রেগের চিকিৎসাও।বিএমওএইচ দাবি করেন,
তাপসীদেবী তাঁর বিশ্বাস ও ভক্তি থেকেই এইসব দাবি করছেন ।।