মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী হত্যাকাণ্ড উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গান্ধীর হত্যাকারী ছিলেন তার মতোই একজন উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ। তাঁর নাম নাথুরাম গডসে। নিপাট দেশপ্রেমী ও স্বজাতীর প্রতি দায়বদ্ধ এক মহান মানুষ । গান্ধীর মুসলিম তোষামোদ, সাম্প্রদায়িক হিংসার সময় হিন্দুদের উপর একতরফা দোষারোপ, জিন্নাহর প্রেমে দেশভাগে সায় দেওয়া, এসবের কারনে তথাকথিত মেকি ধর্মনিরপেক্ষরা বাদে প্রতিটি হিন্দু গান্ধী ও তার দল কংগ্রেসের উপর চরম ক্ষুব্ধ । শুধু গান্ধী নয়, ইসলামপন্থী জহরলাল নেহেরুর তৈরি বেশ কিছু হিন্দু বিরোধী আইন ও মুসলিম প্রীতির ফল আজও কংগ্রেসকে ভুগতে হচ্ছে । দীর্ঘ প্রায় ছয় দশক ক্ষমতায় থাকার পর কংগ্রেস সরতেই তাদের ওই দুই নেতার একের পর এক কীর্তি প্রকাশ্যে আসছে । যেকারণে মোহদাস করমচাঁদকে হত্যার পরে আজও হিন্দুদের একটা বৃহৎ সংখ্যক মানুষ গোডসেকে ‘খুনি’ হিসাবে চিহ্নিত করতে আগ্রহী নয় । কথিত ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থী, চীনের মাও সেতুংকে আদর্শ মনে করা ইতিহাসকার আর সম মানসিকতার ব্যক্তিরাই গডসকে ‘উগ্রবাদী হিন্দু’র তকমা দিয়ে রেখে দিয়েছে এতদিন ধরে ।
আদালতে দেওয়া নাথুরাম গডসের জবানবন্দি প্রমান করে যে দেশ ও নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি নিজেকে কতটা দায়বদ্ধ মনে করতেন ।
নাথুরাম গডসে অল্পশিক্ষিত ছিলেন না। গডসে ছিলেন তার সময়ের শিক্ষিত মানুষদের অন্যতম । হিন্দু ইতিহাস ও হিন্দু শাস্ত্র এবং তদানীন্তন ভারতীয় রাজনীতি সম্পর্কে ছিল তার গভীর জ্ঞান। হিন্দু মন-মানসিকতা ও চেতনার আলোকে তার কাছে মনে হয়েছিল, গান্ধী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সায় দিয়ে হিন্দুদের পুণ্যভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করেছেন । গডসে বিশ্বাস করতেন, গান্ধী মুসলিম লীগ ও মুসলমানদের প্রতি বেশি দায়বদ্ধতা অনুভব করত । হিন্দু স্বার্থের চেয়ে তিনি মুসলিম স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন । জিন্নাহর প্রতি নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করছেন। এছাড়া, গান্ধী রাষ্ট্রভাষা হিসাবে হিন্দির দাবিকে অগ্রাহ্য করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর ভূমিকাকে নাথুরাম গডসে সমর্থন করলেও ভারতীয় রাজনীতিতে তার ভূমিকাকে পুরোটাই অন্যায় বলে বিবেচনা করেছেন তিনি । গান্ধীর অহিংস বাণী ও সত্যাগ্রহ ছিল তার দৃষ্টিতে হিন্দু ইতিহাসের পরিপন্থি। তিনি তাকে ব্রিটিশ রাজের অনুগত ব্যক্তি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি। তিনি মনে করতেন, অষ্টাদশ শতাব্দীতে মোগলদের বিরুদ্ধে ছত্রপতি শিবাজি, রাজা রাবনের বিরুদ্ধে ভগবান রাম ও পৌরাণিক কংসের বিরুদ্ধে অর্জুনের মতো হিন্দু বীরদের সহিংস লড়াইয়ের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অহিংস পথ অবলম্বন করে গান্ধী হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেছেন। তাই তাকে হত্যা করা পুণ্যের কাজ। গডসে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, জাগতিক বিচারে তার পরিণাম যাই হোক, পরজন্মে তিনি মুক্তি পাবেন। শুধু তাই নয়, গান্ধী হত্যাকাণ্ড সফল হলে তার স্বধর্মের অনুসারী ভারতের ৩০ কোটি হিন্দুও অবিচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে। গান্ধী হত্যাকাণ্ডে এগুলোই ছিল নাথুরাম গডসের যুক্তি । তাঁর আরও বিশ্বাস ছিল যে প্রকৃত দেশপ্রেমী মানুষরা একদিন তার সঠিক মূল্যায়ন করবে ।
১৯৩৪ সালের জুলাই থেকে ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৬ বার গান্ধীকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। নাথুরাম গডসে ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার গান্ধীকে হত্যার চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি আবার ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারি একই চেষ্টা চালান। পরপর দু’বার ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বার ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি সফল হন। সেদিন গান্ধী দিলির বিড়লা হাউসে এক প্রার্থনা সভায় যোগদান করেছিলেন। সেখানেই নাথুরাম গডসের গুলিতে তিনি নিহত হন। গান্ধীকে হত্যা করার জন্য গডসের মধ্যে কোনো অনুতাপ ছিল না। তিনি প্রাণভিক্ষাও চাননি। প্রাণদণ্ডের জন্য তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন ।
সাধারণত মানুষ মৃত্যু চিন্তায় অধীর হয়। কিন্তু গডসের মধ্যে সে ধরনের অধীরতা দেখা যায়নি। মৃত্যুকে তিনি হাসিমুখে আলিঙ্গন করেছেন। কিন্তু কেন? এই ‘কেন’র জবাবও নিজের জবানবন্দিতে দিয়ে গেছেন নাথুরাম গডসে । গডসে এ জবানবন্দি দিয়েছিলেন আদালতে। তার জবানবন্দি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটি পাঠ করলে বহু জিজ্ঞাসার জবাব পাওয়া যাবে। জানা যাবে গান্ধী হত্যাকাণ্ডে গডসের কেন কোনো অনুশোচনা ছিল না। শুধু যে ব্যক্তি গডসের ক্ষোভ ও যন্ত্রণার নাগাল পাওয়া যাবে তাই নয়, জানা যাবে হিন্দুদের একটি অংশের মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদদের ঠিক কতটা ঘৃণা পোষণ করে । আদালতে গডসের দেওয়া সেই জবানবন্দির একাংশ তুলে ধরা হল :-
আমি বলি যে আমার গুলি এমন এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছিল যার নীতি এবং কাজ কোটি কোটি হিন্দুর জন্য কেবল ধ্বংস এবং ধ্বংস এনেছে। এমন কোন আইনি প্রক্রিয়া ছিল না যার মাধ্যমে সেই অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা যায়, তাই আমি এই মারাত্মক পথ অনুসরণ করেছি। আমি নিজের জন্য ক্ষমা চাইব না, আমি যা করেছি তার জন্য আমি গর্বিত। আমার কোন সন্দেহ নেই যে ইতিহাসের সৎ লেখকরা ভবিষ্যতে আমার কাজকে মূল্যায়ন করবেন এবং সঠিকভাবে মূল্যায়ন করবেন। ভারতের পতাকা তলে সিন্ধু নদী প্রবাহিত না হওয়া পর্যন্ত আমার চিতাভস্ম নদীতে ভাসিয়ে দিও না ।
প্রতিহত করা এবং সম্ভব হলে বলপ্রয়োগ করে এমন শত্রুকে দমন করাকে আমি ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব মনে করি। মুসলিম লীগ তার নিজস্ব ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করছিল, হয় কংগ্রেস তাদের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের ইচ্ছা, স্বেচ্ছাচারিতা এবং আদিম মনোভাবের সাথে যোগ দেয় অথবা তাদের ছাড়াই কাজ করে । তিনি(গান্ধী) একাই প্রতিটি জিনিস এবং ব্যক্তির বিচারক ছিলেন।
গান্ধী নিজেই নিজের ও উভয়পক্ষের বিচারক ছিলেন। গান্ধীজি মুসলিম লীগকে খুশি করার জন্য হিন্দি ভাষার সৌন্দর্য ও লাবণ্যকে ধর্ষণ করেছিলেন। গান্ধীজীর সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র হিন্দুদের খরচে করা হয়েছিল। কংগ্রেস তার দেশপ্রেম ও সমাজতন্ত্র নিয়ে গর্ব করত। তিনি গোপনে বন্দুকের মুখে পাকিস্তান বিভাজনের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে বিনীতভাবে জিন্নাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
মুসলিম তুষ্টির নীতির কারণে মাদার ইন্ডিয়া টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশের এক-তৃতীয়াংশ আমাদের জন্য বিদেশী ভূমিতে পরিণত হয়। নেহেরু ও তাঁর জনতার গ্রহণযোগ্যতায় ধর্মের ভিত্তিতে একটি পৃথক রাষ্ট্র তৈরি হয়। একেই উনি বলেন ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা। কিন্তু কার আত্মত্যাগ ? কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা যখন গান্ধীজির সম্মতিতে এই দেশটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন, যাকে আমরা পূজা করতাম, তখন আমার মন প্রচণ্ড ক্রোধে ভরে গেল। আমি সাহস করে বলি যে গান্ধী তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। নিজেকে পাকিস্তানের জনক বলে প্রমাণ করেছিলেন ।।