এইদিন বিনোদন ডেস্ক,০৫ জুলাই : বলিউড অভিনেত্রী মন্দাকিনীর উত্থান রাজ কাপুরের ছবি ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’-এর মাধ্যমে । আর পতন কুখ্যাত মাফিয়া ডন সন্ত্রাসী দাউদ ইব্রাহীমের হাত ধরে । ১৯৯৩ সালে মুম্বাইয়ে বোমা বিস্ফোরণে প্রেমিক দাউদের সঙ্গে মন্দাকিনী গোপন ঠিকানায় চলে যান । ছেদ পড়ে বিনোদন জগতের ক্যারিয়ারে । একদিকে দাউদ পাকিস্তানে আত্মগোপন করে । অন্যদিকে মন্দাকিনী চলে যান অন্তরালে । কয়েক দশক পর ফের জনসমক্ষে আসেন বলিউডের ওই অভিনেত্রী । কিন্তু সিনেমার জগতে তিনি অছ্যুৎ থেকে যান । খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মন্দাকিনীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হয়ে ওঠা, বিবাহ ও দুই সন্তানের জননী হয়ে ওঠা পর্বের কাহিনী যেকোনো সিনেমার স্ক্রিপ্টকেও হার মানাবে ।
মন্দাকিনীর জন্ম ১৯৬৩ সালের ৩০ জুলাই উত্তর প্রদেশের মিরাটে। মন্দাকিনী নামে পরিচিত হলেও তাঁর আসল নাম কিন্তু ইয়াসমিন জোসেফ। তবে এ নামে তাঁকে চেনেন খুব কম লোকই। তাঁর বাবার নাম জোসেফ, যিনি একজন ব্রিটিশ এবং তাঁর মা একজন মুসলিম । মাত্র ১৬ বছর বয়সে রাজ কাপুরের চোখে পড়েন। পরে রাজ কাপুরই তাঁর নাম বদলে মন্দাকিনী রাখেন।
রাজ কাপুর ইয়াসমিন জোসেফ ওরফে মন্দাকিনীকে সিনেমার জগতে নিয়ে আসেন । প্রথম ছবি ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ যখন মুক্তি পায়, তখন মন্দাকিনীর বয়স ২২ বছর। এ ছবিতে তাঁকে দেখা যায় রাজীব কাপুরের বিপরীতে অভিনয়ে। মন্দাকিনী গঙ্গার ভূমিকায় অভিনয় করেন, আর রাজীব কাপুরের চরিত্রের নাম ছিল নরেন্দ্র। সিনেমা মুক্তির পর তুমুল জনপ্রিয়তা পায় । সেই সিনেমার কয়েকটি দৃশ্যে খোলামেলা অভিনয় করে রাতারাতি আলোচনায় চলে আসেন মন্দাকিনী। সত্তর-আশির দশকের দর্শকমাত্রই জানেন, এই নাম বলিউডে তখন কেমন আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। তবে এ সিনেমায় দারুণ অভিনয় করেন বলিউডে নবাগতা মন্দাকিনী। এই সিনেমার জন্য তিনি ফিল্মফেয়ারে সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়নও পেয়েছিলেন। তবে শুরুতে রাজ কাপুর এই ছবিতে পদ্মিনী কোলহাপুরেকে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাহসী দৃশ্যে অভিনয় করতে রাজি হননি পদ্মিনী ।
আরও সিনেমা
পরে তিনি আরও কয়েকটি ব্যবসাসফল ছবিতে অভিনয় করেন। মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘ড্যান্স ড্যান্স’, আদিত্য পাঞ্চোলিতের সঙ্গে ‘কাহা হ্যায় কানুন’ এবং গোবিন্দর সঙ্গে ‘পেয়ার করকে দেখো’ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তাঁর প্রথম ছবির মতো বাকিগুলো এত আলোচিত ছিল না।১৯৮৫ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে অভিষেক ঘটে প্রবীণ অভিনেত্রী মন্দাকিনীর এবং তিনি এখনও তাঁর ‘রাম তেরি গঙ্গা মাইলি’ ছবির জন্য মানুষের কাছে পরিচিত। ৪০ বছর বয়সী এই সিনেমাটি এখনও সেই প্রজন্মের মানুষ ভোলেনি। তবে, ‘রাম তেরি গঙ্গা মাইলি’ মন্দাকিনীর প্রথম ছবি ছিল না? হ্যাঁ ! তিনি ১৯৮৫ সালে বাংলা ছবি ‘অন্তরের ভালোবাসা’ দিয়ে তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, একই বছর তিনি ‘মেরা সাথী’ ছবির মাধ্যমে হিন্দি সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ‘আর পার’ এবং ‘রাম তেরি গঙ্গা মাইলি’ দুটি ছবি করেন এবং খ্যাতি অর্জন করেন।
বহুল চর্চিত ব্যক্তিজীবন
মন্দাকিনী তাঁর সিনেমার চেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে। কুখ্যাত গ্যাংস্টার ও আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে তিনি নানা সময়ে হয়েছেন আলোচনার মধ্যমণি। বলিউডপাড়ার জোর গুঞ্জন, তাঁদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। একটি ক্রিকেট ম্যাচে তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে দেখা গেলে সেই গুঞ্জন আরও জোরালো হয়। সম্পর্কের ব্যাপারে মুখ না খুললেও এটা ছিল অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’। মন্দাকিনী-দাউদের সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে একবার একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে এক রোমহর্ষক সংবাদ। প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্দাকিনীকে প্রধান অভিনেত্রী হিসেবে চলচ্চিত্রে না নেওয়ায় দাউদ ইব্রাহিম এক চলচ্চিত্র নির্মাতাকে হত্যা করেন!
মুম্বাই হামলায় দৃশ্যপট বদল
তবে এ পটভূমি বদলে যায় ১৯৯৩ সালে। মুম্বাইয়ে বোমা বিস্ফোরণের মাস্টারমাইন্ড ছিল দাউদ ইব্রাহিম । এ কারণে দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে মন্দাকিনীকেও খুঁজতে থাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা । বিস্ফোরণের ঘটনার পর মন্দাকিনী আত্মগোপনে চলে যান। পরে দাউদের সঙ্গে তাঁর কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার ব্যাপার অস্বীকার করেন।
কয়েক বছর পর মন্দাকিনী সব ছেড়ে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হয়ে যান। তিনি দালাই লামার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরে তিনি বৌদ্ধধর্মের এক প্রাক্তন সন্ন্যাসীকে বিয়ে করেন। তাঁর নাম কাগিউর টি রিনপোচ ঠাকুর। স্বামীর পদবি অনুসরণ করে তিনি তাঁর নামের শেষে ঠাকুর পদবি যোগ করেন। তিনি নিজেকে এখন ইয়াসমিন জোসেফ ঠাকুর নামেই পরিচয় দিয়ে থাকেন। বিয়ের পর তাঁদের একটি পুত্র ও একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। তাঁর ছেলের নাম রাব্বিল, মেয়ের নাম রাব্বে ইয়ান্না।
৩০ বছর নেই অভিনয়ে
১৯৯৬ সালে ‘জোরদার’ ছবির পর আর সিনেমা করেননি মন্দাকিনী। চলচ্চিত্র অঙ্গনকে বিদায় জানানোর পর কেটে গেছে দীর্ঘ ২৯ বছর। তবে অভিনেত্রী এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি আবার অভিনয়ে ফিরতে চান। তিনি সে সময় বেশ কিছু সিরিজ নির্মাতার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন শোনা যায়। কংগ্রেস সরকারের সময় চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য একটি পুরস্কার অনুষ্ঠানে তাঁকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় । পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস মন্দাকিনীকে প্রচারের হাতিয়ার করে । বর্ধমান শহরে মন্দাকিনীর রোড শো করেছিল তৃণমূল ।
উধাও পরিচালক
কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে নানা কথা ভাগ করে নেন অভিনেত্রী মন্দাকিনী। জানান, তাঁর স্বামী কাগিউর টি রিনপোচ ঠাকুর ছিলেন হিমাচল প্রদেশের বাসিন্দা। প্রথম যখন দেখা হয় তাঁদের, হিন্দি একেবারেই বলতে পারতেন না হবু বর। কীভাবে তাহলে পরস্পরকে মনের কথা বোঝাতেন তাঁরা ? মন্দাকিনী জানান, তাঁর হবু শাশুড়ি হিন্দি জানতেন । তাঁদের কথোপকথনের সময় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থাকতেন তিনিই । এই সাক্ষাৎকারে তাঁর পেশাগত জীবন সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণাও ভেঙে দেন অভিনেত্রী। ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ ছবির বিপুল সাফল্যের পরও কেন তিনি আরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেননি, সে কথাও জানান মন্দাকিনী। তিনি বলেন, অনেক প্রস্তাবে তিনি প্রাথমিকভাবে রাজি হয়েছিলেন। একটি ছবির কাজ শুরুও করেছিলেন। কিন্তু মাত্র ১০ দিনের মধ্যে পরিচালক রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যান। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি আর। সৌভাগ্যক্রমে ছবির জন্য কিছু টাকা অগ্রিম পেয়েছিলেন তিনি। সেটি ভাগ্য বলেই মানেন মন্দাকিনী
কোথায় আছেন মন্দাকিনী
১৯৯০ সালে মন্দাকিনী প্রাক্তন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ডাঃ কাগিউর টি রিনপোছে ঠাকুরকে বিয়ে করেন । বর্তমানে মন্দাকিনী এবং তার স্বামী রিনপোছে মুম্বাইতে একটি তিব্বতি ভেষজ কেন্দ্র পরিচালনা করেন। এর পাশাপাশি মন্দাকিনী যোগব্যায়ামও শেখান। এই দম্পতির দুটি সন্তান রয়েছে। তার ছেলের নাম রাব্বিল এবং মেয়ের নাম রাব্বে।।

