প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৯ ফেব্রুয়ারী : শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে নেমে একের পর এক রাঘববোয়াল কে জালে পুরে চলেছে সিবিআই।তা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় জারি থাকার মাঝেই এমবিবিএসে ভর্তির নামে প্রতারণার একটি বড়সড় চক্রের হদিশ পেল পুলিশ। বর্ধমান থানার পুলিশ ওই প্রতারণা চক্রের চারজনকে ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার করেছে। চক্রের বাকিদের নাগাল পুলিশ জোরদার তৎপরতা শুরু করেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতদের নাম বিক্রম ঠাকুর, রহমান শেখ ওরফে রাজু, শেখ সান্টু ও পীযূষকান্তি ঘড়াই। শক্তিগড়ের সিনেমাতলা এলাকায় বিক্রমের বাড়ি। উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুর থানার বামনগাছির পূর্বপাড়ায় রহমানের বাড়ি। কলকাতার কসবা থানার প্রসন্ন নস্কর লেনে সান্টুর বাড়ি। কলকাতার নরেন্দ্রপুর থানার তেঁতুলবেড়িয়ার নতুনপাড়ায় পীযূষের বাড়ি। শুক্রবার গভীর রাতে বাড়ি থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ধৃতদের কাছ থেকে কিছু আপত্তিকর নথি পুলিশ পেয়েছে । তার মধ্যে গ্রুপ ডি পদের একটি নিয়োগপত্রও রয়েছে বলে পুলিশের দাবি। ধৃতদের ব্যবহৃত একটি গাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রতারণা চক্রে আরও কয়েকজন জড়িত বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।চক্রের জাল জেলায় জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে বলেও পুলিশের অনুমান। পুলিশ এও জেনেছে,কেবল এমবিবিএসে ভর্তির নামে নয়, বিভিন্ন সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা হাতানোতেও গ্যাংটি জড়িত। চক্রের বাকি অভিযুক্তদের নাগাল পেতে ও হাতিয়ে নেওয়া টাকা
উদ্ধারের জন্য চার ধৃতকে শনিবার বর্ধমান আদালতে পেশ করে পুলিশ ১০ দিনের জন্য নিজেদের হেপাজতে নিয়েছে। রবিবার থেকে শুর হয়েছে তাদের জেরা পর্ব ।
পুলিশ কর্তাদের কথায় জানা গিয়েছে, কলকাতার কসবা থানার রাজডাঙা মেন রোডের বাসিন্দা শুভাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এবছরের ৭ জানুয়ারি একটি ফোন আসে। তাঁর মেয়ে নিট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু, র্যাঙ্কের কারণে তিনি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাননি। তিনি কাউন্সেলিংয়েও হাজির হননি। ফোনে মেয়েকে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। নমিনি কোটায় তাঁর মেয়েকে ভর্তি করে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয় তাঁকে। ভর্তির জন্য সরকারি ফি ছাড়াও তাদের কমিশন দিতে হবে বলে জানানো হয়। প্রথমে প্রস্তাবে তিনি রাজি হননি। বেশ কয়েকবার ফোন আসার পর তিনি রাজি হন। ১৭ জানুয়ারি দুপুরে তাঁকে বর্ধমানে আসতে বলা হয়। সেইমতো তিনি বেলা দেড়টা নাগাদ মেয়েকে নিয়ে বর্ধমানে আসেন। বর্ধমান স্টেশনে শচীন নামে এক ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে।
এরপর তাঁকে ও মেয়েকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। শচীন কিন্তু কলেজের ভিতরে যায়নি। অন্য একজন তাঁদের কলেজের ভিতরে নিয়ে যায়। সেখানে কলেজের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসারের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। কক্ষের বাইরে সেই প্রফেসারের নেমপ্লেট লাগানো ছিল। কক্ষের ভিতরে ডাক্তারের মতো সেজে থাকা দু’জন ছিল। তাদের মধ্যে একজন তাঁর মেয়ের কাছ থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতার সমস্ত নথিপত্রের আসল নেয়। একসেট জেরক্সও নেওয়া হয়। এরপর তাঁদের কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হয়। কিছুক্ষণ পর প্রফেসার পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি বেরিয়ে আসেন। সে ভর্তির কাগজপত্র দেয়। ভর্তির নথিতে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের মতো সই করা ছিল। ভর্তির ফি বাবদ তাঁর কাছ থেকে ড্রাফ্ট নেওয়া হয়। ভর্তির জন্য তাঁর মেয়েকে ২৪ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে কলেজে আসতে বলা হয়। পরে সেইসব নথিপত্র জাল বলে জানতে পারেন শুভাশিস। তিনি ঘটনার কথা জানিয়ে বর্ধমান থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
এমন বিস্ফোরক অভিযোগ পেয়েই জাল নথিপত্র তৈরি করে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ তদন্তে নামে । তদন্তে নেমে মেডিক্যাল কলেজের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পুলিশ সংগ্রহ করে । যে নম্বর থেকে প্রতারকরা ফোন করেছিল তার কল ডিটেলস রেকর্ডও পুলিশ সংগ্রহ করে। এইসবের সূত্রে বিক্রমকে শনাক্ত করে পুলিশ। সে গ্যাংয়ের অন্যতম মাথা বলে নিশ্চিত হন তদন্তকারীরা। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাকি তিনজনের নাম জানতে পারে পুলিশ। এরপর তাকে নিয়ে বাকিদের বাড়িতে হানা দেওয়া হয় ।।