প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৬ অক্টোবর : কথায় আছে-“রাখে হরি তো মারে কে”। সেটাই যেন ঘটে গিয়েছে পূর্ব বর্ধমানের রায়না থানার জাকতা গ্রামের ৮৭ বছর বয়সী বৃদ্ধা মাতুরী টুডুর জীবনে। রবিবার দুপুরে ভরা দামোদরে স্নান করতে নেমে ছিলেন মাতুরী । স্নান সেরে ঘাটে ওঠার সময় পা হড়কে যাওয়ায় তিনি দামোদরের গভীর জলে গিয়ে পড়েন।তবে তিনি জলে ডুবে যাননি। তিনি ভরা দামোদর নদের জলে ভাসতে ভাসতে ওইদিন সন্ধ্যায় পৌছে যান প্রায় ৪৫ কোলোমিটার দূরে জামালপুর থানার মুইদিপুরে। সেখানে দামোদর ও মুণ্ডেশ্বরী নদীর সংযোগ স্থল বেগোর মুখের কাছে থাকা সাঁকোর খুঁটিতে বৃদ্ধার শরীর আটকা পড়ে। সেখানে “বাঁচাও বাঁচাও” বলে বৃদ্ধা মাতুরী আর্ত চিৎকার করছিলেন । সেই সময় ছোট নৌকায় চড়ে টর্চলাইট জেলে ওই জায়গায় মাছ ধরছিলেন স্থানীয় মৎসজীবীরা । নদীর জলে ভাসমান অবস্থায় থাকা বৃদ্ধার আর্তনাদ শুনতে পেয়েই মৎসজীবীরা জীবন্ত অবস্থায় বৃদ্ধাকে উদ্ধার মুদিপুর উত্তর পাড়ার দুর্গা মন্দিরে নিয়ে যান। দীর্ঘক্ষণ জলে ভেসে কাহিল হয়ে পড়া বৃদ্ধার পরণে থাকা ভিজে কাপড় জামা খুলে দিয়ে তাঁর সেবা শুশ্রুষা শুরু করেন গ্রামের মহিলারা।
এলাকার ভিলেজ পুলিশ সঞ্জিত দাসের কাছ থেকে এই খবর পেয়েই জামালপুর থানার পুলিশ কর্তারা ঘটনাস্থলে পৌছান । তারা বৃদ্ধাকে নিয়ে জামালপুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌছান । সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রাতে বৃদ্ধাকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে সারারাত বৃদ্ধা মাতুরী টুডুর চিকিৎসা চলে। চিকিৎসায় আপাতত সুস্থ মাতুরী।হাসপাতাল থেকে ছুটি মেলার পর সোমবার বেলায় মা মাতুরী টুডুকে নিয়ে জাকতা গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন মেয়ে লক্ষ্মী। তবে এই ঘটনা বৃদ্ধার পরিবার পরিজন থেকে শুরু পুলিশ এবং প্রশাসন সবাইকেই অবাক করে দিয়েছে।
রায়না-১ নম্বর ব্লকের হিজলনা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম জাকতা।এই জাকতা গ্রামের
খুব কাছ দিয়েই বয়ে গিয়েছে দামোদর নদ।মাতুরী টুডুর মেয়ে লক্ষ্মী হেমব্রমের শ্বশুর বাড়ি জাকতা গ্রামে । মাতুরীর স্বামী দুলা টুডু অনেক দিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন। তারপর থেকে প্রায় ৩০ বছর হল বৃদ্ধা মাতুরী টুড তাঁর মেয়ে লক্ষ্মীর কাছেই রয়েছেন। আধার ও ভোটার কার্ড অনুযায়ী জাকতা গ্রামই এখন মাতুরীর স্থায়ী ঠিকানা।মাতুরীর মেয়ে লক্ষ্মী হেমব্রম, জামাই গুরুপদ হেমব্রম ও নাতি রমানাথ হেমব্রম খেতমজুরির কাজ করে সামন্য যেটুকু উপার্জন করেন তা দিয়েই তাঁদের দিন গুজরান হয়।
শুরুপদ হেমব্রম এদিন জানান,তাঁর শাশুড়ি মাতুরী টুভু রবিবার দুপুর ১২ টা নাগাদ বাড়ির কাছে দামোদর নদে স্নান করতে যান। তার পর থেকে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাবার পরেও তিনি বাড়ি না ফেরায় আমরা পরিবারের সবাই খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। সবাই মাতুরীর খোঁজ শুরু করি । কিন্তু রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা মাতুরী টুডুর কোন খোঁজ পাই না।ভরা দামোদরে স্নান করতে নেমে তিনি তলিয়ে গেলেন কি না, সেই দুশ্চিন্তা আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। তারই মধ্যে রবিবার রাতে জামালপুর থানার পুলিশ মাধ্যমে আমরা জানতে পারি দামোদরের জলে ভাসতো ভাসতে আমার শাশুড়ি মা মাতুরী টুডু জামালপুরের জ্যোৎশ্রীরাম পঞ্চায়েত এলাকার মুইদিপুরে চলে গিয়েছেন। সেখানকার মানুষজন আমার শাশুড়ি মাকে উদ্ধার করেছে।
শুরুপদ হেমব্রম এও জানান, শাশুড়ি মাকে পাওয়া যাওয়ার খবর পেয়ে রাতেই তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ও ছেলে মিলে রাতেই জামালপুর ব্লক হাসপাতালে মাতুরী টুডুর কাছে পৌছে যান। মাতুরী তখন আমাদের জানান, দামোদরে স্নান সেরে তিনি ঘাটে উঠছিলেন । ওই সময়ে তাঁর পা হড়কে যাওয়ায় পিছলে গিয়ে তিনি ভরা দামোদরের স্রোতের মধ্যে পড়ে গিয়ে ভেসে যান।কিছু আর পাড়ে উঠতে পারেন না। বৃদ্ধা মাতুরীর নাতি রমানাথ হেমব্রমও এদিন একই কথা জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়া ষষ্ঠ সিন্ধু জয়ী বাংলার সাঁতারু কন্যা সায়নী দাস গোটা ঘটনার কথা শুনে বলেন,’বৃদ্ধার মনের জোরকে আমি কুর্নিশ জানাই’
। একই সঙ্গে তিনি এও জানান ,“জলে যত দুর্ঘটনা হয় তাতে আতঙ্ক’ই (Panic) হয় মৃত্যুর অন্যতম কারণ। আমার মনে হয়,“ভরা দামোদরে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গিয়েও বৃদ্ধা মাতুরী টুডু কোন কারণে আতঙ্কিত (Panicked) না হয়ে পড়াতেই উনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন।’।