প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৪ মে : বাড়িতে পাঠ্য পুস্তক,খাতা, পেন স্কুলের ব্যাগ সবই রয়েছে।শুধু নেই বেঁচে থাকার রসদ ও চিকিৎসা করিয়ে অসুস্থ বাবাকে সুস্থ করে তোলার মত অর্থের সংস্থান।তাই আপাতত লেখাপড়া শেখার ইচ্ছাকে শিকেয় তুলে রেখে টোটো রিক্সাকেই জীবনের একমাত্র অবলম্বন হিসাবে বেছে নিয়েছে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছাত্রী রাত্রি মালিক।নিজের অসহায় পরিবারের মুখ চেয়ে চোদ্দ বছর বয়সী এক ছাত্রীর এমন জীবনসংগ্রাম যেন অনেকের জীবনসংগ্রামের কাহিনীকেও হার মানিয়ে দিয়েছে।
রাত্রি মালিকের বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের কালনা ১ নম্বর
ব্লকের নিভুজি বাজার এলাকায়। সে স্থানীয় কৃষ্ণদেবপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। আর পাঁচটা পরিবারের ছেলে মেয়ের মত রাত্রিও লেখাপড়া শিখে জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতো । কিন্তু রাত্রির সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তাঁর বাবা মদন মালিক দু’বছর আগে সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর। বাড়ির একমাত্র উপার্জন শীল বাবা শারীরিক অসুস্থতার কারণে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় রাত্রিদের গোটা পরিবার যেন অথৈ জলে পড়ে যায় ।
বাড়িতে রয়েছে ছাত্রীর দেড় বছর বয়সী ভাই। মা গৌরী মালিক অপরের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ শুরু করেছেন।কিন্তু পরিচারিকার কাজের সামান্য পারিশ্রমিকে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার খরচ জোগানো ও সংসার সম্ভব হচ্ছিল না। অভাব কুরে কুরে খাচ্ছিল পরিবারকে। কোনদিন একবেলা আবার কোনদিন আধপেটা খেয়ে মালিক পরিবারের সদস্যদের দিন কাটছিল।এই পরিস্থিতিতে পরিবারের সবার অন্নের সংস্থানের জন্য ছাত্রী রাত্রি লেখাপড়ার পাঠ শিকেয় তুলে রেখে নিজেই টোটো চালিয়ে অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।নাবালিকার চালানো অটোতে
সওয়ার হয়েই কালনার অনেক বিদ্বজ্জন গন্তব্যে
পৌছান।তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ছাত্রীর অসহায়তার কথা শুনে পাশে থাকার আশ্বাস দেন । আবার কেউ কেউ সহানুভূতি দেখানোর পরিবর্তে মুখ ঘুরিয়ে চলে যান।যদিও এইসব নিয়ে রাত্রি মাথা ঘামাতে চায় না। তাঁর এখন একমাত্র লক্ষ্য নিজের উপার্জনের অর্থে অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করানো ও ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষকরা।
ছাত্রীর বাবা মদন মালিক বৃহস্পতিবার বিছানায় হেলান দিয়ে বসে চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন,
আমার ভাগ্য সত্যি খারাপ। তাই আমার নাবালিকা মেয়েই এখন আমার ও আমার পরিবারের ভরসা । সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর আমি শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছি। আমার ছোট্ট মেয়েটা অপরের টোটো দৈনিক ভাড়ায় নিয়ে চালিয়ে উপার্জন করে আমার চিকিৎসা করাচ্ছে ,পরিবারের সবার মুখেও অন্ন যোগাচ্ছে ।
মা গৌরীদেবী বলেন,কোন বাবা মা চাননা লেখাপড়া শিকেয় তুলে তাঁদের নাবালিকা মেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টোটো রিক্সা চালিয়ে উপার্জনে নেমে পড়ুক।কিন্তু আমাদের পরিবারের চরম অর্থ সংকট আমার নাবালিকা মেয়েকে বাধ্য করেছে টোটো চালিয়ে অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নিতে। কারণ স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর কোনদিন আমাদের খাবার জুটেছে, আবার কোনদিন উপবাসেই কাটাতে হয়েছে। গৌরীদেবী এও বলেন,লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার স্বপ্ন আমার মেয়েরও ছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে মেয়ের সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে।পাশে দাড়িয়ে সহযোগীতার হাত বাড়ানোর জন্য গৌরীদেবী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ সকল হৃদয়বান মানুয়ের উদ্দেশ্যে আবেদন রেখেছেন।
রাজ্যের নারী,শিশু ও সমাজকল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী শশী পাঁজা সব শুনে বলেন,ওই ছাত্রীর বাবা মা তাঁদের সমস্যার সবিস্তার জেলাশাসককে জানাক ।
অবশ্যই সরকার ও প্রশাসন তাঁদের পাশে দাঁড়াবে“।
কালনা ১ ব্লকের বিডিও শুভঙ্কর বালা। তিনি এদিন বলেন,“বিষয়টি জেনেছি। এসডিও স্যারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।তার কাজও চলছে ।।