প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৩ মে : “কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করেনিতে হবে। নয়তো ফল ভালো হবে না“। পথে বের হলেই অজানা দুষ্কৃতীদের এমন হুমকির মুখে এখন পড়তে হচ্ছে ভারতীয় ডাকঘরে সঞ্চয়ের টাকা গচ্ছিত রেখে প্রতারিত হওয়া সুরজিৎ পালকে । তবে হুমকিতে দমেন নি পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থানা এলাকার বাসিন্দা সুরজিৎ পাল । তিনি এই হুমকির ঘটনার সবিস্তার লিখিত ভাবে ডি.আই.জি-সিআইডি এবং জেলার পুলিশ সুপার কে জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহনের আর্জি রেখেছেন।সিআইডি ও পুলিশ কি ব্যবস্থা নেয়,সে দিকেই এখন তাকিয়ে সুরজিৎ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ।
কলকাতা হাইকোর্টে মামলাকারী পাল পরিবার থাকেন জামালপুর হাটতলা এলাকার। ষাটোর্ধ্ব পরিবার কর্তা রণজিত পাল, মাটির কলসি ,হাঁড়ি তৈরি করে জামালপুর হাটে বসে বিক্রী করেন।তাঁর স্ত্রী রাধারাণী পাল কঠিন রোগে আক্রান্ত।দীর্ঘদিন ধরে তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। রণজিত পালের এক মেয়ে মধুমিতা বিবাহিত।আর দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে অভিজিৎ ইলেকট্রিকের কাজ করেন। ছোট ছেলে সুরজিৎ জামালপুর বাজারে ফল বিক্রির পাশাপাশি অন্য কায়িক পরিশ্রমের কাজও করেন।
সুরজিৎ পাল জানিয়েছেন,তাঁদের পরিবারের সকলেই পরিশ্রম করে রোজগার করা অর্থ থেকে কিছু কিছু করে জমিয়ে রাখতেন।জমানো অর্থ জামালপুর সাব পোস্ট অফিসে গচ্ছিত রাখার জন্য তিনি এবং তাঁর বাবা, মা,দিদি ও জামাইবাবু আলাদা আলাদা অ্যাকাউন্ট খোলেন।২০২১ সালে ১ বছরের ’ফিক্সড ডিপোজিট’ স্কিমে তাঁরা নিজের নিজের অর্থ অ্যাকাউন্টে জমা করেন।তাঁদের সবার মিলিয়ে জমা করা টাকার পরিমাণ ১২ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। তদানিন্তন জামালপুর সাব পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার বিদ্যুৎ সুর ওই টাকা গ্রহণ করে নিয়ে শীল স্ট্যাম্প দিয়ে তাঁদের সবার অ্যাকাউন্ট বই ইস্যু করেদেন বলে সুরজিৎ জানিয়েছেন।
ভারত সরকারের অধীন জামালপুর সাব পোস্ট অফিসে সঞ্চয়ের টাকা ফিক্সিড ডিপোজিট করে নিশ্চিন্তেই ছিলেন পাল পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু ফিক্সড ডিপোজিটের মেয়াদ ১বছর উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন সুরজিৎতের মা রাধারাণী দেবী। তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতা সহ ভিন রাজ্যের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।তখন টাকার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়লে পাল পরিবারের সদস্যরা অগ্রিম ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে টাকা তুলে নেওয়ায় জন্য জামালপুর সাব পোস্ট অফিসে যান। তখনই পোস্ট মাস্টারের কথা শুনে তাঁদের মাথায় হাত পড়ে যায় ।
পাল পরিবারের সদস্যদের কথা অনুযায়ী, পোস্ট অফিস থেকে দেওয়া ফিক্সড ডিপোজিটের সমস্ত “নথি“ নিয়ে তাঁরা পোস্ট অফিসে টাকা তুলতে যান ।কিন্তু পোস্ট অফিসের একই পোস্ট মাস্টার বিদ্যুৎ সুর তখন সেই নথি হাতেনিয়ে দেখেঈ তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা শুরু করেদেন।সুরজিৎ পাল বলেন,’ওইদিন শুধু দুর্ব্যবহার করাই নয়,বিদ্যুৎ সুর আঙুল উঁচিয়ে আমাদের বলেদেন,“আমরা নাকি কোন টাকা পোস্ট অফিসে ফিক্সড ডিপোজিট’ই করিনি’। “যা করতে পারিস করে নিগে যা“, এই মন্তব্য করে বিদ্যুৎ সুর আমাদেরকে পোস্ট অফিষ থেকে এক প্রকার তাড়িয়ে দেয় ।’
সুরজিৎ জানান,এমন প্রতারণার বিহিত চেয়ে তাঁরা জামালপুর সাব পোস্ট অফিসের তদানিন্তন পোস্ট মাস্টার বিদ্যুৎ সুরকে আসামী করে বর্ধমান আদালতে মামলা রুজু করেন।একই সাথে জেলা পুলিশ সুপার সহ জেলা ও রাজ্যের প্রধান ডাক বিভাগ,এমনকি সিবিআই দফতরেও গোটা ঘটনা সবিস্তার লিখিত ভাবে জানান।কিন্তু কোন সুরাহা না মেলায় ন্যায় বিচার পেতে তাঁরা গত বছরের শেষের দিকে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন।সেই প্রতারণার মামালায় বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেন ।
হাইকোর্টের সেই নির্দেশ মেনে সিআইডি জোরদার তদন্তে নামে।সিআইডি অফিসাররা জামালপুর সাব পোস্ট অফিসে গিয়ে তদন্ত চালান।এছাড়াও বিভিন্ন পোস্টাল এজেন্টকে একপ্রস্থ জিজ্ঞাসাবাদ সেরেছে সিআইডি।আরও অনেককে সন্দেহের তালিকায় রেখে সিআইডি অফিসাররা নিজস্ব কায়দায় তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছে। এসবের মধ্যেই কলকাতা হাইকোর্টর বিদ্যুৎ সুরের জামিনের আবেদনও খারিজ করে দেয়। এদিকে সিআইডি তদন্তে গতী বাড়াতেই সুরজিৎ পালের বিপদ বেড়েছে। সুরজিৎ রাজ্যের ডিআইজি সিআইডি ও জেলার পুলিশ সুপারকে জানিয়েছেন,জামালপুর সাব পোস্ট অফিসের প্রতারণা নিয়ে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে যে মামলা করছেন সেই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য কিছু ’অজানা’ ব্যক্তি তাঁকে চাপ দিচ্ছে।বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখাচ্ছে।
যাঁরা ভয় দেখাচ্ছে তাঁরা করা ? এই প্রশ্নের উত্তরে সুরজিৎ জানিয়েছে,রুটি রুজি জোগাড়ের জন্য তাঁকে বাইরে কাজে যেতে হয়।কাজের জায়গায় যাওয়ার জন্য কিছুদিন আগে তিনি তাঁর বাইকে চেপে মেমারি -তারকেশ্বর রোড ধরে যাচ্ছিলেন।সেই সময় একটি বাইকে চেপে থাকা অজ্ঞাত পরিচয় দুই ব্যক্তি তাঁর পিছু নেয়।ওই ব্যক্তিদের মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা ছিল, মাথায় ছিল হেলমেট। তারা সারাংপুর ও চৌবেড়িয়া পুলের মাঝে ফাঁকা জায়গায় তাঁর পথ আটকায়। হুঁশিয়ারি দিয়ে তারা তাঁকে বলে,“কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের করা মামলা তুলে নিতে হবে, নয়তো পরিণাম ভাল হবে না“। সুরজিৎতের কথা অনুযায়ী,এমন হুমকির বিষয়টি তাঁর কাছে যথেষ্টই ভয়ের ও উদ্বেগের মনে হয়েছে ।তাই তিনি এই ঘটনা সবিস্তার লিখিত ভাবে জেলার পুলিশ সুপার ও ডি.আই.জি-সিআইডি কে জানিয়েছেন।
এদিকে এমন হুমকি কাণ্ডের কথা জেনে যথেষ্টই বিস্মিত পাল পরিবারের হয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা লড়ে যাওয়া আইনজীবীরা উদয়শংকর চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন,পুলিশের উচিৎ অবিলম্বে সুরজিৎ পাল ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা । বর্ধমান আদালতে পাল পরিবারের হয়ে মামলা লড়ছেন আইনজীবী অতনু সরকার। তিনি বলেন,’আর্থিক প্রতারণার ঘটনায় জামালপুর সাব পোস্ট অফিসের মুখ্য অভিযুক্তর জামিন খারিজ করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। তার পর থেকে ওই আধিকারিক ফেরার রয়েছেন । এমন অবস্থার মধ্যেই ওই অভিযুক্তর সাঙ্গোপাঙ্গরা আমার মক্কেল সুরজিত পালকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। এটা কখনোই ক্ষম্মস করা যায় না।পুলিশ ও প্রশাসনের উচিৎ সুরজিৎ পাল সহ তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।’ এনিয়ে পুলিশ কি ভাবছে,তা জানার জন্য জেলার পুলিশ সুপার সায়ক দাসকে ফোন করা হয় । কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় নি।।

