জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,আউশগ্রাম,০৮ নভেম্বর :‘এ্যাই লোকজন এসে গেছে, পাতা দিতে শুরু কর’ – পারিবারিক হোক বা সামাজিক যেকোনো উৎসবে উদ্বিগ্ন গৃহকর্তার মুখ থেকে নিঃসৃত এই বাক্য বন্ধনী শোনার সৌভাগ্য আমন্ত্রিতদের সঙ্গে পরিবেশনকারী – সবার হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের অপেক্ষায় বসে থাকা পরিবেশনকারীরা নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শালপাতা দিয়ে তৈরি থালা খাওয়ার টেবিলে সাজাতে শুরু করে। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন কৃত্রিম থালা বাজারে এলেও শালপাতা দিয়ে তৈরি থালা এখনো অনেকেই পচ্ছন্দ করে। শালপাতা দিয়ে শুধু থালা নয় বাটিও তৈরি হয়। সেগুলি পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি করেনা । এই শালপাতা দিয়ে থালা, বাটি তৈরির পেছনে অনেক মেহনত ও ঝুঁকি লুকিয়ে আছে। কিন্তু পরিশ্রমের তুলনায় আয় খুব কম। তারই করুণ কাহিনী শোনা গেল আদিবাসী অধ্যুষিত আউশগ্রামের আদিবাসী কন্যা ছবি মাড্ডির কাছ থেকে।
ছবি মাড্ডি জানান, পূর্ব বর্ধমান জেলা কৃষিপ্রধান হলেও সেচ বা বৃষ্টির জলের অভাবে জঙ্গল অধ্যুষিত আউশগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় কৃষিকাজ যথেষ্ট কম হয়। পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজতেই হয়। বাড়ির পুরুষরা অন্য এলাকায় কাজ করতে যাওয়ার সুযোগ পেলেও মহিলারা সবসময় সেটা পায়না। সংসারের প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গল থেকে শালপাতা সংগ্রহ করে থালা তৈরি করাকে তারা আয়ের উৎস হিসাবে বেছে নেয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি ফের বলতে শুরু করেন, দিনের আলো ফোটার আগেই শালপাতা সংগ্রহ করার জন্য ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করতে হয়। প্রথম ভয় হিংস্র বন্যপ্রাণী ও বিষধর সাপের। সেগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেলেও অনেক সময় নারীলোভী মানুষের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়না। নির্জন জঙ্গলের সুযোগ নিয়ে অসহায় নারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নারীলোভীরা। পেটের দায়ে শালপাতা সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজের সম্মান নষ্ট পর্যন্ত করতে হয় আমাদের মত দুস্থ মহিলাদের ।
তিনি জানান,পাতা সংগ্রহ করে সেগুলো রোদে শুকাতে দিতে হয়। সেখানেও মাঝে মাঝে প্রকৃতিও শত্রুতা শুরু করে। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি! বৃষ্টির হাত থেকে পাতাগুলো রক্ষা করতে বাড়ির বাচ্চাদেরও অনেক সময় হাত লাগাতে হয়। ভিজে গেলে আবার নতুন করে শুকাতে হবে। বৃষ্টির জন্য কিছু পাতা নষ্ট হয়ে যায়।সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে সন্ধ্যার সময় শুরু হয় থালা তৈরির কাজ। একটার পর একটা পাতা সাজিয়ে তৈরি করা হয় থালা। মাঝে মাঝে বাড়ির পুরুষরাও থালা তৈরির কাজে হাত লাগায়। কাজটা যথেষ্ট কষ্টের।
তিনি বলেন,’অনেক সময়, বিশেষ করে উৎসব মরশুমে, পাতা তৈরি করতে গিয়ে রাত শেষ হয়ে যায়।ক্লান্ত শরীর নিয়ে পরদিন আবার শুরু হয় পাতা তোলার কাজ। অবশেষে থালার বান্ডিল তৈরি করে সেগুলি তুলে দিতে হয় মহাজনের হাতে। এত পরিশ্রমের বিনিময়ে যথাযথ মজুরি পাওয়া যায়না। যেটা পাওয়া যায় তাতে আর যাইহোক পেট ভরেনা।
ছবিদেবী বললেন,পাতা তোলা থেকে থালা তৈরি পর্যন্ত অনেক কষ্ট করতে হয়, মজুরি পাওয়া যায়না।
ছবিদেবী বলেন,’শালপাতার থালা মূলত উৎসব বাড়ি ও হোটেলে ব্যবহার করা হয়। এখন সেখানে কৃত্রিম থালার ব্যবহার বেশি। ফলে চাহিদা কমার সঙ্গে সঙ্গে আয়ও কমছে। সরকার যদি আমাদের কথা ভেবে কিছু একটা ব্যবস্থা করে তাহলে খুব ভাল হয় । ভালভাবেই সন্তানদের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে পারব।’
স্থানীয় বিধায়ক অভেদানন্দ থাণ্ডার বললেন, অবশ্যই ওদের সমস্যা নিয়ে কুটির শিল্প দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করব। আশাকরি ভাল কিছু একটা হবে।’ কিন্তু কবে তিনি আলোচনা করবেন ? এর উত্তর অবশ্য মেলেনি । এদিকে বছরের পর বছর ধরে শাসকদলের ‘গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখা’র প্রতিশ্রুতি ছাড়া আউশগ্রামের শালপাতা তৈরির কাজে যুক্ত শ্রমিকদের এযাবৎ কিছুই মেলেনি । তবুও পেটের তাগিদে নিরুপায় হয়ে একই কাজ করে যেতে বাধ্য হচ্ছেন তারা । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের ‘কুবের’ চরিত্রের মতই আউশগ্রামের শালপাতা তৈরির শ্রমিকরা বুঝে গেছে যে ‘বঞ্চিত হওয়া তাদের জন্মগত অধিকার’ ।।