এইদিন ওয়েবডেস্ক,ভাতার(পূর্ব বর্ধমান),১৯ ডিসেম্বর : স্বামী পূর্ত বিভাগে পিয়নের চাকরি করেন । দুই ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়ুয়া । হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছিল তারা । পাশাপাশি শহরে থাকতে থাকতে বিলাসbহুল জীবন অভ্যস্ত হয়ে পড়েন । এদিকে স্বামীর সীমিত উপার্জনের সিংহভাগ টাকা বেরিয়ে যাচ্ছিল দুই সন্তানের পড়াশোনা ও নিজের আভিজাত্য প্রদর্শনের খরচ খরচায় । ফলে মাসে মাসে আরও টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে । সেই কারণে পেশায় ব্যবসায়ী নিঃসন্তান বৃদ্ধ মেসোমশাইয়ের গচ্ছিত অর্থের ওপর নজর পড়েছিল পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতারে জোড়া খুনের ঘটনায় ধৃত বধূ মহুয়া সামন্ত ওরফে কেয়ার । কিন্তু মাসি সবিতা যশ (৬৫) ও মেসোমশাই অভিজিৎ যশ (৭২) প্রথমদিকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করলেই পরে মহুয়াদেবীকে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন । আর সেই আক্রোশেই দুই সন্তানকে সাথে নিয়ে মাসি ও মেসোকে হত্যা করে লুটপাট চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি । কিন্তু একজন সাধারণ ঘরের গৃহবধুর মনের মধ্যে এই প্রকার অপরাধপ্রবণ মানসিকতা থাকতে পারে ভেবে বিস্মিত হচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারা ।
গত মঙ্গলবার বিকেলে ভাতার বাজারের রবীন্দ্রপল্লী এলাকায় নিজের বাড়ি থেকে অভিজিৎ যশ ও সবিতা যশের নিথর দেহ উদ্ধার করে ভাতার থানার পুলিশ । পুলিশ বিভিন্ন সূত্র মারফত জানতে পারি যে অভিজিৎবাবুর মৃত সেজ শালী সঞ্চিতাদেবীর মেয়ে মহুয়া সামন্তর যাতায়ত ছিল তার বাড়িতে । সেই সূত্রে পুলিশ তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই খুনের কথা কবুল করেন মহুয়া দেবী । পুলিশ চেপে ধরতেই এই জোড়া খুনের ঘটনায় নিজের দুই ছেলে অরিত্র সামন্ত(১৯) এবং অনিকেত সামন্তর (১৮) জড়িত থাকার কথাও তিনি কবুল করেন ।
জানা গেছে,ধৃত মহুয়া সামন্তর মামাশ্বশুরের বাড়ি ভাতার থানার কুলচন্ডা গ্রামে । স্বামী প্রতাপ সামন্ত ওরফে পিন্টু ছোট থেকে মামার বাড়িতেই মানুষ । তাদের বিয়েও হয় মামারবাড়িতেই । দুই সন্তান অরিত্র ও অনিকেতের জন্ম কুলচন্ডা গ্রামেই হয় । চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত তারা কুলচন্ডাতে থেকেই পড়াশোনা করেছে । প্রতাপ সামন্তর বাবা সরকারি চাকরি করতেন । কিন্তু তিনি অবসরের আগে মারা গেলে সেই চাকরি পেয়ে যান প্রতাপ । এরপর তিনি চাকরির সুবিধার্থে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বর্ধমান শহরে চলে যান । শহরের মিঠাপুকুর এলাকায় সরকারি আবাসনে স্ত্রী ও দুই ছেলের সঙ্গে থাকতেন । তাদের বড় ছেলে অনিকেত বর্তমানে মালদায় একটি বেসরকারি কলেজে পলিটেকনিক পাঠরত। ছোট অরিত্র মগরায় একটি কলেজে পলিটেকনিক পড়ছিলেন ।
জানা যায়,বর্ধমান শহরে থাকতে থাকতে বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন মহুয়াদেবী । বাড়িতে রয়েছে একাধিক বিলিতি কুকুর। মহুয়াদেবীর পাখি পোষার শখও ছিল। নিজে বিলাসবহুল জীবনযাপন পছন্দ করতেন । দুই ছেলেকেও সেইভাবে রাখার চেষ্টা করতেন । ছেলেরা ছিল মায়ের অনুগত। কিছু ছেলেদের পড়াশোনা ও আভিজাত্য বজায় রাখতে গিয়ে প্রতিমাসে প্রচুর টাকার প্রয়োজন হচ্ছিল,স্বামীর সীমিত উপার্জনে কুলচ্ছিল না । সেই কারনে নিঃসন্তান মাসি-মেশোমশাইয়ের উপর তার নজর পরে ।
জানা গেছে, মহুয়াদেবীর মামারবাড়ি ভাতারের পালাড় গ্রামে। তাঁর মায়েরা ছিলেন ৫ বোন। সবার বড় ছবিরাণী ওরফে সবিতাদেবী। মহুয়ার বাবা সন্তোষ দে ভাতারে একসময় চালকল চালাতেন। বাবা এবং মা সঞ্চিতাদেবী অনেক আগেই মারা যান। সেই থেকে মহুয়া তাঁর মাসি সবিতাদেবীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন । অন্যদিকে মহুয়াদেবীর মেসোমশাই নিহত অভিজিৎ যশ ভাতার গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পরিবারের অভাবের কারণে ছোটবেলাতেই লরির খালাসি হিসাবে কাজে লেগে যান। কঠোর পরিশ্রম করে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমে একটি পুরানো লরি কিনে ব্যবসার শুরু। তারপর রড, সিমেন্ট ইত্যাদি নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা করতেন। পালাড় গ্রামে তার শ্বশুরবাড়ি। জীবনে ব্যবসায়ী হিসাবে সফল। নিজের চেষ্টাতেই তিনি কোটিপতি হয়েছিলেন। স্থানীয় সুত্রে জানা গিয়েছে নিজে মিতব্যয়ী হলেও আত্মীয় পরিজনদের প্রয়োজনে বহু টাকা খরচ করেছিলেন অভিজিতবাবু। নিজের ভাই, ভাইপো দের চেয়ে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে অভিজিতবাবুর সম্পর্ক বেশি নিবিড় ছিল । শালির মেয়ে মহুয়ার বিয়েতেও প্রচুর টাকা খরচ করেন তিনি ।
এদিকে ছেলেদের পড়াশোনা ও নিজের বিলাসবহুল জীবন জারি রাখতে স্বামীর সীমিত উপার্জনে কুলিয়ে উঠতে না পেরে টাকা ধার নেওয়া অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেন মহুয়াদেবী । তিন সপ্তাহ আগে থেকেই তিনি মাসি-মেশোমশাইয়ের কাছে টাকা চেয়ে আসছিলেন । কিন্তু বারবার টাকা চাওয়ায় তাতে সাড়া দেননি বৃদ্ধ নিঃসন্তান দম্পতি অভিজিৎ যশ ও সবিতা ওরফে ছবিরাণী যশ । আর টাকা না পেয়ে শেষপর্যন্ত মাসির বাড়িতে লুঠের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন মহুয়া সামন্ত । দুই ছেলে অনিকেত এবং অরিত্রকে সঙ্গে নিয়ে শেষবারের মত গত শনিবার ভাতারের রবীন্দ্রপল্লীতে মাসির বাড়িতে এসেছিলেন মহুয়া। আর ওদিনই দুজনকে শ্বাসরোধ করে খুন করে ঘরের আলমারিতে থাকা নগদ টাকা এবং গহনা লুঠ করে পালায় তাঁরা ।
কুলচন্ডা গ্রামের বাসিন্দা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন,’প্রতাপের স্ত্রী যে এমন কাজ করতে পারে তা ভেবেই অবাক লাগছে । যতদিন আমাদের গ্রামে ছিল কখনো তার মধ্যে খারাপ কিছু দেখিনি । খুন দুরেও কথা, কারোর কোনো জিনিসপত্র চুরি করে নেওয়ার মানসিকতা তার ছিল না । হয়ত ছেলেদের পড়াশোনার খরচ জোটাতে না পেরে সে এতবড় অপরাধ করে ফেলেছে ৷’
এদিকে বুধবার ধৃতদের বর্ধমান আদালতে তুলে ১৪ দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। বর্তমানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে ৷ পাশাপাশি মহুয়ার স্বামী প্রনব বাবুকেও একপ্রস্ত জেরার মুখে পড়তে হয় । তার দাবি,’আমার স্ত্রী ও ছেলেরা মিলে যে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে আমি আদৌ জানতাম না। আমি অফিসে ডিউটিতে চলে গিয়েছিলাম। তারপর ওরা কোথায় গিয়েছিল জানতাম না। এই কয়েকদিন আমাকে কেউ কিছু বলেওনি।’ সূত্রের খবর, তিনি স্ত্রী ও দুই ছেলের উশৃংখল জীবন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, মাসের শেষে বেতন স্ত্রীর হাতে তুলে দিতাম । স্ত্রী ও ছেলের উশৃংখলতার কারনে ওদের দিকে নজর দিতাম না । আমি আমার মত থাকতাম,ওরা ওদের মত থাকত ।’ যদিও ধরা পড়ার পর কৃতকর্মের জন্য মহুয়া সামন্তর মধ্যে তেমন কোনও অনুশোচনা লক্ষ্য করা যায়নি। সেই তুলনায় মনমরা দেখা গিয়েছে তার দিই অনিকেত ও অরিত্রকে। আজও ভাতার বাজারের রবীন্দ্রপল্লি এলাকায় মৃত বৃদ্ধ দম্পতির বাড়িতে তদন্তে যায় তদন্তকারী দল৷ তার আগে বুধবার রাতে পুলিশ ধৃত মহুয়া সামন্ত ও তার দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে মৃত বৃদ্ধ দম্পতির বাড়িতে তদন্তে গিয়েছিল বলে স্থানীয় সূত্রে খবর ।।