প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৪ নভেম্বর : বর্গী হানায় একদা তছনছ হয়ে গিয়েছিল সারা বাংলা । তার রেশ পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষের ওঁয়াড়ি গ্রামেও আছড়ে পড়েছিল । কথিত আছে প্রায় পাঁচ শতাধীক বছরকাল আগের সেই বর্গী হামলায় নিজের আশ্রয় হারাতে হয়েছিল ওঁয়াড়ি গ্রামের বাসিন্দাদের আরাধ্য দেবী বড়মাকে । শ্মশান সংলগ্ন পরিত্যক্ত জায়গায় বড়মার ঠাঁই হয়েছিল । দীর্ঘদিন সেখানেই তিনি পড়েছিলেন । স্বপ্নে দেবী এই গ্রামের বাসিন্দা বুদ্ধদেব সরকারকে তার দুরাবস্থার কথা জানান । এরপরেই দেবীকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে বুদ্ধদেববাবু প্রথম পুজোপাঠ শুরু করেন । পরে মন্দির গড়ে বড়মাকে প্রতিষ্ঠা করা হয় ।
সেই থেকে প্রতি বছর কার্তিকেয় আমাবস্যা তিথিতে কালি পুজোর দিন ওঁয়াড়ি গ্রামে ঘটা করে হয়ে আসছে বড় মায়ের আরাধনা । বর্গীদের মহিষাসুরের সঙ্গে তুলনা করে বড়মায়ের পুজোয় একদা মোষ বলি হত । সেই সময়ে মহিষাসুর বধের উল্লাশে বড়মার প্রতিমার সামনে লাঠি খেলায় মাতোয়ারা হতেন ওঁয়াড়ি গ্রামের হিন্দু ও মুসলিম যুবকরা । এখন মোষ বলিদান আর না হলেও সেই প্রথামেনে কালী পুজোর দিন বড়মার সামনে হয় লাঠি খেলা । দেবী বড়মাকে আঁকড়ে ধরেই ওঁয়াড়ি গ্রামে বিরাজমান রয়েছে সম্প্রীতির অটুট বন্ধন ।
ওঁয়াড়ি গ্রামে বড়মা দেবী কালী রুপে পূজিতা হলেও আদতে তিনি দুর্গাকালি রূপী । বড়মার প্রতিমা প্রকৃত অর্থেই নজরকাড়া। গনেশ , কার্তিক , লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সঙ্গে দুই পরী জয়া ও বীজয়াকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠিতা দুর্গা কালী রূপী বড়মা । নিজের মাহাত্ম গুনেই বড়মা ওঁয়াড়ি গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে অনন্য দেবী রুপে ভূষিতা হয়েছেন । এলাকাবাসীর বিশ্বাস বড়মায়ের কাছে কেউ কিছু চাইলে বড়মা তাকে নিরাশ করেন না । তাই শ্রদ্ধায় গ্রামের সকলেই তার কাছে মাথানত করেন ।
পূর্বে গ্রামের সরকার বাড়িতে পূজিতা হতেন বড়মা । এখন তিনি পূজিতা হন ওঁয়াড়ি গ্রামের সার্বসাধারণের বড়মা রুপে । দেবীর মন্দিরটিও তৈরি হয়েছে বিশাল আকারে । শোনা যায় একসময়ে বড়মায়ের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে সাতশো বিঘা । এখন সেসব ইতিহাস । জানা গেছে, সামান্য ৩০ – ৩৫ বিঘা দেবত্তর সম্পত্তি এখন রয়েছে বড় মায়ের নামে । সেই জমির আয় থেকেই সারা বছর বড়মায়ের নিত্য সেবা ও কার্তিকের আমাবস্যা তিথির বিশেষ পুজোপাঠ হয় । পুজো সাতদিন ধরে চলে ।
পুজারী তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন , তন্ত্র মতেই হয় বড়মায়ের পুজো । মায়ের পুজোর ভোগ অন্নে দিতেই হবে চালকলাই ভাজা ও চিনি ।পুজারি জানান ,আগে মহিষাসুর বধকে স্মরন করে হত মোষ বলি । তবে মোষ বলিদান এখন আর আর হয়না । উপাচার মেনে ছাগ , আখ ও ছাঁচি কুমড়ো বলিদান হয় । কালি পুজোর দিন থেকে শুরু করে সাত দিন ধরে চলে বড় মার বিশেষ পুজোপাঠ । বছরের অন্য দিন গুলিতে গ্রামের বাসিন্দাদের কেউ কর্মসূত্রে বাইরে থাকলেও পুজোর সাতটি দিনের জন্য সবাই ফিরে আসেন গ্রামে ।পুজোর সাত দিন উৎসব মুখর থাকে সমগ্র ওঁয়াড়ি গ্রাম । এলাকায় বসে বিশাল মেলা । হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও যাত্রা পালা ।
বড়মার প্রতিমার রূপ ও মাহাত্ম নিয়ে ওঁয়াড়ি গ্রামের বাসিন্দা মহলে অনেক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে । এলাকার বাসিন্দা মুসূদন চন্দ্র বলেন,’কথিত আছে চরম দারিদ্রতা মধ্যে দিনযাপন করতেন গ্রামের সরকার পরিবারের পূর্ব পুরুষ বুদ্ধদেব সরকার । উদাস মনের এই মানুষটি কালী মায়ের ভক্ত ছিলেন ।’ মধুসূদন বাবু বলেন,’গ্রামের প্রবীনরা বলে থাকেন , ওঁয়াড়ি গ্রামের একপাশে ছিল শ্মশান ঘাট । সেখানে নিজের পোষা গরু চড়াতে যেতেন বুদ্ধদেববাবু । গরু চড়াতে চড়াতে একদিন সেখানেই বুদ্ধদেব ঘুমিয়ে যান । স্বপ্নে বড়মা তাকে দেখা দেয় । বড়মা বুদ্ধদেবকে বলেন , বর্গী হামলায় তার সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে । বর্গীরা সব মন্দির ধ্বংস করে দিয়েছে । নিজের দুরাবস্থার কথা বুদ্ধদেবকে জানিয়ে বড়মা বলেন , তিনি খুব কষ্টে রয়েছেন । বড়মার নির্দেশ দিয়ে বুদ্ধদেবকে বলেন , ‘আমাকে শ্মশান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়ে তোর বাড়িতে প্রতিষ্ঠা কর । এই সময় বুদ্ধদেব মাকে বলেন , আমি নিজেই দুবেলা খেতে পাইনা । তোমাকে প্রতিষ্ঠা করে কি খাওয়াবো ? তখন দেবী বুদ্ধদেবকে জানিয়ে দেন সামান্য চাল কলাইভাজা আর একটু চিনি দিবি তা দিয়েই আমার খাওয়া হয়ে যাবে । একই সঙ্গে বড়মা নির্দেশ দিয়ে বুদ্ধদেবকে বলেছিলেন, লক্ষ্মী, সরস্বতী , কার্তিক ও গনেশও দুরাবস্থায় রয়েছে । আমার সঙ্গে ওদেরও প্রতিষ্ঠা করে পুজো করবি । বড়মার সেই নির্দেশ মেনেই বুদ্ধদেব বড়মার পুজোপাঠ শুরু করেন । সেই থেকে গনেশ , কার্তিক , লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়েই দুর্গাকালী রুপে ওঁয়াড়ি গ্রামে পূজিতা হয়ে আসছেন বড়মা ।’।