শ্যামসুন্দর ঘোষ,কলকাতা,২৬ জুলাই : সম্প্রতি একটা ভিডিও ব্যাপক ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে । ভিডিওটি এক পুরুষ ও এক মহিলার যৌন সঙ্গমের মুহুর্তের । তাদের দু’জনেরই উর্ধাঙ্গের পোশাক থাকলেও নিম্নাঙ্গের পোশাক খোলা দেখা যাচ্ছে । তিন মিনিট দুই সেকেন্ডের ওই ভিডিওটি কলকাতার সল্টলেকের বিজেপি কার্যালয়ের এবং পুরুষটি স্বয়ং বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা দিলীপ ঘোষের বলে দাবি করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় । কেউ কেউ সেটা নিশ্চিত করতে ভিডিও-এর কিছু স্ক্রিনশট পোস্ট করে প্রমাণ উপস্থাপন করার চেষ্টাও করেছেন । যদিও ক্যামেরা তুলনামূলক ভাবে দুর্বল হওয়ায় গেরুয়া জামা পরা পুরুষটি ও কালো পোশাকের মহিলার মুখ স্পষ্ট চেনা যায়নি ।
যাই হোক,এনিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে চলছে চাপানউতোর । তৃণমূল বলছে এটা বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি ৷ ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরেই তৃণমূলপন্থী বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলি দিলীপ ঘোষের হয়েই সওয়াল করছেন । যদিও বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বিষয়টি তেমন আমল দিতে চাইছেন না । কিন্তু স্বয়ং দিলীপ ঘোষ সংবাদমাধ্যমের কাছে কোনো সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেননি । তারই ফলশ্রুতিতে আজ শনিবার ভিডিও ভাইরাল করার নেপথ্যে কারা খুঁজে বের করতে লালবাজারের সাইবার ক্রাইম থানার দ্বারস্থ হলেন বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ ৷ বিষয়টিকে তিনি ‘সম্মানহানি এবং রাজনৈতিকভাবে কালিমালিপ্ত করতে সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে’ বলে দাবি করেছেন । তিনি অজ্ঞাত ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পুলিশের কাছে আবেদনও জানিয়েছেন ।
প্রসঙ্গত,গত ৩০ এপ্রিল দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনের দিন সস্ত্রীক দিঘায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে দিলীপের কথিত সৌজন্য সাক্ষাৎ মেনে নিতে পারেনি বিজেপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা । বিশেষ করে মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জ ও ধুলিয়ানে সাম্প্রদায়িক হিংসায় হিন্দুরা যখন খুন,অরাজকতার শিকার ও ঘরছাড়া হচ্ছিল সেই পরিস্থিতিতে দিলীপের এই প্রকার সৌজন্য সাক্ষাৎ বিজেপির কেউই ভালো চোখে নেয়নি । ফলশ্রুতিতে তাকে কার্যত দলের মধ্যে একঘরে হয়ে থাকতে হচ্ছে । যদিও এযাবৎ দিঘায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ নিয়ে নিজের অবস্থানে অনড় আছেন দিলীপ । শুধু তাইই নয়,একারনে তার সমালোচনাকারী বিজেপি সমর্থক কিছু ইউটিউব চ্যানেল, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের তিনি “বেজম্মা”, “কুকুর”, “শয়তানের বাচ্ছা” বলে গালাগালি পর্যন্ত করেছিলেন । আর ঠিক তার দু’একদিনের মধ্যে ভাইরাল হয় ওই অশ্লীল ভিডিওটি । এখন কলকাতা পুলিশের কোর্টে বল । পুলিশ সেই বল কিভাবে ব্যবহার করে সেটাই দেখার বিষয় ।
শুভেন্দু-দিলীপ দ্বন্দ্ব
প্রসঙ্গত,২০২০ সালের ১৯ শে ডিসেম্বর মেদিনীপুরে এক সমাবেশে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অমিত শাহের হাত ধরে বিজেপিতে যোগদান করেন নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মুখ শুভেন্দু অধিকারী । শুভেন্দু হলেন রাজ্যের এমন একজন নেতা যাকে মমতা ব্যানার্জির বিকল্প হিসাবেই মনে করে রাজ্যের মানুষ । তাদের দাবি ধারে ও ভারে দিলীপের থেকে কয়েক গুণ এগিয়ে শুভেন্দু । ৫ বছর আগে সেই মেগা যোগদান সভাতে উপস্থিত ছিলেন বিজেপির তৎকালীন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও । কিন্তু শুভেন্দুর মত তৃণমূলের একজন হেভিওয়েট নেতার যোগদানের পরেও দিলীপের শারিরীক ভাষায় তেমন খুশি দেখা যায়নি বলে দাবি করেন রাজনৈতিক মহল । অনেকের মতে, সেই সময় থেকেই অস্তিত্ব সঙ্কটের আশঙ্কা গ্রাস করে বিজেপির এই বর্ষীয়ান নেতার মধ্যে । তারপর শুভেন্দু- দিলীপের মধ্যে কখনো সম্পর্ক সহজ হয়নি, উলটে দুরত্ব বেড়েছে । সেটা চরম আকার ধারন করে বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় । দিলীপ তার পছন্দের জায়গা মেদিনীপুরে টিকট না পেয়ে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে বারবার বিষোদগার করতে থাকেন ৷ বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে তৃণমূল প্রার্থীর কাছে পরাজিত হওয়ার পর আসন বদলের জন্য “কলকাঠি নাড়ার” কথা বলে মূলত শুভেন্দুকেই নিশানা করেন তিনি । এখনো তার জের চলছে । নাম না করে কথার মারপ্যাঁচে শুভেন্দুকে বিদ্ধ করে গেছেন দিলীপ ।
কিন্তু দিঘায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথিত সৌজন্য সাক্ষাতের পর থেকেই অনেকটা ব্যাকফুটে আছেন দিলীপ ঘোষ । তার উপর কয়েকবার মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করে তিনি দলের আরও বিরাগভাজন হন । এমনকি তৃণমূলের একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে তার দলবদল নিয়েও শুরু হয় জোর জল্পনা । যাই হোক তিনি দলবদল করেননি । কিন্তু এখন অশ্লীল ভিডিও ভাইরালের পর তিনি আরও চাপে পড়ে গেছেন । এই ঘটনার নেপথ্যে কারা এবং কি উদ্দেশ্যে তারা এই কাজ করেছে তা খুঁজে বের করতে রাজ্য পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন দিলীপ ঘোষ ।
আশা করা হচ্ছে যে পুলিশমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পুলিশের কাছে যথাযথ সহযোগীতা পাবেন দিলীপ । কারন ২০২০ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে শাসকদলের নিশানায় বারবার শুভেন্দু থাকলেও দিলীপকে তারা সর্বদা সেফ সাইডে রেখে দিয়েছে । ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি এখনো প্রযুক্তিগতভাবে পরীক্ষিত সত্য বা মিথ্যা প্রমাণিত না হলেও শুভেন্দু ছোটো-ছোটো বিষয়ে সরব হওয়া শাসকদল এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নীরব । উলটে তৃণমূলের কুনাল ঘোষের মত নেতারা এবং তৃণমূলপন্থী কিছু বাংলা সংবাদপত্র খোলাখুলি দিলীপের হয়েই সওয়াল করছে । তারা নাম না করে শুভেন্দু অধিকারীর দিকে ইঙ্গিত করছে । ফলে এই ভাইরাল ভিডিওকে কেন্দ্র করে পুলিশকে কাজে লাগিয়ে মমতা ব্যানার্জি যদি শুভেন্দু-দিলীপের বাকযুদ্ধ আরও উসকে দিতে পারে তাহলে ২৬শের নির্বাচনে তৃণমূল তার সুফল ঘরে তুলতে পারবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক অভিজ্ঞমহল ।।