মুঘল শাসকদের অনেক ইতিহাস ভারতের বামপন্থী ইতিহাসকাররা সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে রেখে দিয়েছে এতদিন ধরে । কিন্তু সত্য কোনদিন চাপা থাকে না । তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ওই সমস্ত বামপন্থী ইতিহাসকারদের অপপ্রচেষ্টাও কোনদিন চাপা থাকেনি । আস্তে আস্তে তা প্রকাশ্যে আসছে । আপনারা হয়তো শুনলে অবাক হবেন হানাদার মুঘলদের মধ্যে এমন একজন শাসক ছিলেন যিনি কথিত প্রেমকে অমর করে রাখতে তার নিজের ঔরসজাত মেয়েকেই নিকাহ করে রীতিমত সংসার করেছিলেন । হ্যাঁ…. এরকম এক মুঘল শাসকের নাম হল শাহজাহান । স্ত্রী মমতাজের মৃত্যুর পর শাহজাহান তার বড় মেয়ে জাহানারাকে নিকাহ করেন । কারণ তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে তিনি মুমতাজের মতো দেখতে তার মেয়ে জাহানারা । আর মেয়ের প্রতি যৌনলালসা চরিতার্থ করতে তার তথাকথিত ‘অমর প্রেম’কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন শাহজাহান ! কিন্তু শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ কিভাবে মারা গিয়েছিল শুনলে আপনার অবাক হবেন । শাহজাহানের চতুর্দশ সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময়, মমতাজ ১৬৩১ সালের ১৭ জুন মারা যান ।
মমতাজ যখন মারা যান, জাহানারার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর, এবং শাহজাহান তার রূপ দেখে নিজের মেয়ের প্রতি কামাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন । মমতাজের স্মৃতির অজুহাত দেখিয়ে শাহজাহান তার নিজের কন্যা জাহানারাকে নিকাহ করে নিজের কামনা চরিতার্থ করেছিলেন বলে দাবি করেন কেউ কেউ । বলা হয় যে জাহানারাও নিজের বাবার সাথে নিকাহ করতে আপত্তি করেননি কারণ তিনিও তার বাবার অবস্থা দেখে গভীরভাবে প্রভাবিত হন । মমতাজ মহল এবং শাহজাহানের জাহানারা নামে দ্বিতীয় সন্তান ছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী জাহানারা একজন উজ্জ্বল, ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন যিনি রাজনীতি সম্পর্কেও অনেক কিছু বুঝতেন। তাদের বিয়ে গোপন করতে এবং অপবাদ ঠেকাতে শাহজাহান জাহানারাকে “পাদশাহ বেগম” উপাধি দেন । এটি এমন একটি মর্যাদা যা তাকে সম্মান করতে এবং তাদের সম্পর্ককে কালিমালিপ্ত থেকে রক্ষা করার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই শিরোনামটি সম্মানের একটি চিহ্ন বজায় রাখার এবং তাদের সম্পর্কে যেকোন সম্ভাব্য সমালোচনাকে বিভ্রান্ত করার একটি উপায় ছিল।
এদিকে আওরঙ্গজেব তার ক্রমাগত দুষ্টুমির জন্য তার পিতার প্রতি বিরক্ত হন। সিংহাসনে আরোহণের জন্য তার পিতা শাহজাহানকে কারারুদ্ধ করা এবং তার নিজের ভাই দারা শিকোহকে হত্যার পেছনে এই যুক্তি ছিল । ইতিহাসের এই অধ্যায়টি লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল কারণ মুঘলদের পরে ব্রিটিশরা দখল করে নেয় দিল্লির মসনদ । যাইহোক, পরে বামপন্থী তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসবিদরা এই ধরনের অথ্যগুলি আধুনিক গসিপ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, কারণ এই ঘটনার সপক্ষে কোনো সাক্ষীর উল্লেখ করা হয়নি ।
জাহানারার সাথে শাহজাহানের বিয়ে সম্পর্কে জল্পনা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে, এমন একটি সময় যখন মুঘল ইতিহাসের অনেক দিক পুনর্ব্যাখ্যা এবং যাচাই-বাছাইয়ের বিষয় ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের পতন এবং ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের উত্থানের সাথে সাথে মুঘল সম্রাটদের সম্পর্কে বিভিন্ন আখ্যান উত্থাপিত হয় । শাহজাহান তার মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন বলে দাবির সত্যতা নিশ্চিত করে এমন কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রমাণ বা নির্ভরযোগ্য সাক্ষীর বিবরণ নেই। কারন মুঘল শাসকরা নিজেদের পারিবারিক কুকীর্তি চার দেওয়ালের মধ্যে সীমিত রাখতে সর্বতোভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন ।
কন্যা জাহানারার সাথে শাহজাহানের বিবাহের কাহিনী মুঘল ইতিহাসের একটি আকর্ষণীয় কিন্তু সন্দেহজনক অংশ হিসাবে রয়ে গেছে। যদিও মুমতাজ মহলের মৃত্যুর পরে মানসিক অশান্তি নিঃসন্দেহে শাহজাহানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, তার মেয়ের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের দাবির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাব রয়েছে। বামপন্থী ঐতিহাসিকরা মুঘল শাসককে মহিমান্বিত করতে এই ঘটনাকে কল্পকাহিনী বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছে ৷ কিন্তু বামপন্থী ঐতিহাসিকদের মিথ্যাচারিতা ইতিমধ্যে বহু ঘটনায় ধরা পড়ায় তারা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।
শাহজাহানের মৃত্যুর পর কি পরিণতি হয়েছিল জাহানারা বেগমের ?
শাহজাহানের প্রধান রানী তথা পাদশাহ বেগম জাহানারা ১৬৬৮ থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন সম্রাট শাহজাহান এবং মমতাজ মহলের দ্বিতীয় এবং জীবিত সবচেয়ে বড় সন্তান ৷ পিতার শাসনকালে তিনিই মূলত রাজনৈতিক চালিকাশক্তি ছিলেন এবং সেই সময়ে তাকে “সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী মহিলা” হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।বাবার অন্য তিনজন স্ত্রী থাকা মাত্র ১৭ বছর বয়সে সত্ত্বেও মুঘল সাম্রাজ্যের ফার্স্ট লেডি (পাদশাহ বেগম) হিসেবে তার মায়ের স্থান গ্রহণ করেন জাহানারা ৷ তার ক্ষমতা এমন ছিল যে, অন্যান্য রাজকন্যাদের মতো নয়, তাকে আগ্রা ফোর্টের সীমানার বাইরে তার নিজের প্রাসাদে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। ১৬৫৭ সালে শাহজাহানের অসুস্থতার পরে সংঘটিত উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময়, জাহানারা আপাত উত্তরাধিকারী দারার পক্ষে ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত আগ্রা ফোর্টে তার বাবার সাথে যোগ দেন, যেখানে তাকে আওরঙ্গজেব গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন ।অনুগত স্ত্রীর মত তিনি ১৬৬৬ সালে শাহজাহানের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার যত্ন নেন। শাহজাহানের মৃত্যুর পর জাহানারা আওরঙ্গজেবের সাথে পুনর্মিলন করেন যিনি তাকে ‘রাজকুমারী সম্রাজ্ঞী’ উপাধি দেন এবং তার ছোট বোন রাজকুমারী রোশনারা বেগমকে ফার্স্ট লেডি হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করেন। আওরঙ্গজেবের শাসনকালেই বিধবা অবস্থায় মৃত্যু হয় জাহানারার । ১৬৪৪ সালের মার্চ মাসে, ত্রিশতম জন্মদিনের মাত্র কয়েক দিন পর, জাহানারা গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হয়ে অল্প সময় পরেই মারা যান ।
সঙ্গত কারণে এখানে কয়েকটি প্রশ্ন ওঠে । ভারতের ইতিহাসে মুঘল সম্রাটদের বামপন্থী ইতিহাসবিদরা সর্বদাই মহিমান্বিত করে গেছে । যে ব্যক্তি আট হাজার নারীকে তার হারেমে রাখে,একাধিক বিয়ে করে, সেই শাহজাহানকে প্রেমের মূর্ত প্রতীক হিসাবে তুলে ধরা কতটা ন্যায়সঙ্গত ? জানলে অবাক হবেন যে মমতাজের নাম শুধু মমতাজ মহলই ছিল না, তার আসল নাম ছিল ‘আরজুমান্দ-বানো-বেগম’ । তাছাড়া শাহজাহান ও মমতাজের মধ্যে যে প্রেম নিয়ে বামপন্থী ইতিহাসকাররা এত গর্বিত, সেই মমতাজ প্রথম স্ত্রীও ছিলেন না। শাহজাহানের সাত স্ত্রীর মধ্যে মমতাজ ছিলেন চতুর্থ। এর মানে মমতাজকে নিকাহ করার আগে শাহজাহান ৩ বার বিয়ে করেছিল এবং মমতাজকে বিয়ে করার পরেও সে সন্তুষ্ট ছিল না এবং তার পরেও সে আরও ৩টি বিয়ে করেছিল, এতটাই যে মমতাজের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে তার বোন ফারজানার সাথে বিয়ে হয়েছিল। যাকে সে তার উপপত্নী হিসাবে রেখেছিল ।
শাহজাহান যদি মমতাজকে এতই ভালোবাসতেন তাহলে মমতাজকে বিয়ে করার পরও কেন শাহজাহান মেয়ের পাশাপাশি আরও ৩টি বিয়ে করলেন? শাহজাহানের সাত স্ত্রীর মধ্যে মমতাজ সবচেয়ে সুন্দরী ছিলেন না, তাঁর প্রথম স্ত্রী ছিলেন ইশরাত বানো। শাহজাহানকে বিয়ে করার সময় মমতাজ কুমারী মেয়ে ছিলেন না কিন্তু তিনিও বিবাহিত ছিলেন এবং তার স্বামী শাহজাহানের সেনাবাহিনীর একজন সুবেদার ছিলেন যার নাম ছিল ‘শের আফগান খান’। শের আফগান খানকে হত্যার পর শাহজাহান মমতাজকে বিয়ে করেন শাহজাহান ।
এটিও লক্ষণীয় যে ৩৮ বছর বয়সী মমতাজ কোন রোগ বা দুর্ঘটনার কারণে নয় বরং তার চতুর্দশ সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় চরম দুর্বলতার কারণে মারা গিয়েছিলেন, অর্থাৎ শাহজাহান তাকে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বানিয়ে কি হত্যা করেননি? শাহজাহান তার কামুকতার জন্য এতটাই কুখ্যাত ছিলেন যে অনেক ইতিহাসবিদ তার নিজের মেয়ে জাহানারার সাথে যৌন সম্পর্কের অভিযোগও করেছেন। শাহজাহান ও মমতাজের বড় মেয়ে জাহানারা দেখতে অবিকল তার মায়ের মতোই ছিল, এ কারণেই মমতাজের মৃত্যুর পর শাহজাহান তার নিজের মেয়ে জাহানারাকে স্মরণ করে শারিরীক ভাবে মিলিত হতে শুরু করেন। শাহজাহান জাহানারাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে তাকে বিয়ে করতেও দেননি।বাবা-মেয়ের এই প্রেম দেখে রাজপ্রাসাদে আলোচনা শুরু হলে মোল্লা-মৌলবীদের একটি সভা ডাকা হয় এবং তারা এই পাপকে ‘জায়েজ’ করার জন্য হাদিস থেকে উদ্ধৃত করে । শুধু তাই নয়, তিনি জাহানারার প্রেমিকদের কাউকে তার কাছে যেতে দেননি। কথিত আছে, একবার জাহানারা যখন তার এক প্রেমিককে বিয়ে করছিলেন, তখন শাহজাহানকে দেখে ভয় পেয়ে হারেমের তন্দুরে লুকিয়ে পড়েন এবং তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে দেন। আর এমন লম্পট নৃশংসদের বামপন্থী ইতিহাসবিদরা প্রেমের উদাহরণ হিসাবে পেশ করেছেন ।।