আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর জেনারেল শাহনাওয়াজ খানের কিছু কর্মকাণ্ড তাকে বিতর্কিত করে তুলেছিল । নেতাজী আহ্বানে সাড়া দিয়ে ব্রিটিশ সেনার চাকরি ছেড়ে ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীতে (আজাদ হিন্দ ফৌজ) যোগদান….মেজর জেনারেল হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই….কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকুল হতেই সেই ব্রিটিশদের স্নেহধন্য জহরলাল নেহেরুর হাত ধরে ক্ষমতার অলিন্দে বিচরণ…. শাহনাওয়াজ খান কি ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য নেতাজীর সঙ্গে “বিশ্বাসঘাতকতা” করেছিলেন ? এই প্রশ্ন ওঠে বারবার ।
অথচ এই শাহনাওয়াজ খানকে নেতাজি অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন ও ভরসা করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি নেহেরুর সাথে হাত মিলিয়ে তাঁর মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়ে শুধু আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনার মনোবলকে দুর্বল করেননি, বরঞ্চ নেতাজীর সাথেও তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন বলে মনে করেন কেউ কেউ ।
এছাড়া, নেতাজীর অস্তিত্বকে মিটিয়ে ফেলতে নেহেরু যে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিলেন,তার অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন এই শাহনাওয়াজ খান । নেতাজীর কথিত মৃত্যু রহস্য সামনে আনার কথা বলে যে প্রথম কমিশন গঠন করেছিলেন নেহেরু, তার প্রধান ছিলেন শাহনাওয়াজ খান ৷ নেহেরুর ইশারাতেই তিনি নেতাজীকে বারবার “মৃত” প্রমান করতে চেয়েছিলেন । নেহেরুর অঙ্গুলিহেলনে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর রিপোর্ট পেশ করেছিলেন তিনি । কি স্বার্থ জড়িয়ে ছিল শাহনাওয়াজের ? অর্থ বা প্রতিষ্ঠার স্বার্থ, যে কারণে নেতাজী প্রেমী ও জাতীয়তাবাদী মানুষ শাহনাওয়াজ খানকে “ক্ষমতালোভী ও বিশ্বাসঘাতকের” তকমা দিয়েছেন ?
নেতাজীকে নিয়ে একাধিক গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে শাহনাওয়াজ খানের মানসিকতা নিয়ে গম্ভীর প্রশ্ন ওঠে । নেহেরুর গঠিত প্রথম কমিশন ‘শাহনাওয়াজ কমিটি’র অন্যতম সদস্য ছিলেন নেতাজির দাদা ‘ সুরেশ চন্দ্র বোস ’। তিনি কমিটির রিপোর্টে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন এবং অভিযোগ করেছিলেন যে, শাহনওয়াজ খান তার কাছে তদন্তের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করেছে । বেগতিক বুঝে নেহেরু কাজে লাগায় তার দলেরই নেতা ও বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে । সুরেশ চন্দ্র বোসের উপর চাপ সৃষ্টি করেন বিধানচন্দ্র । এমনকি তাকে রাজ্যপাল হওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয় । কিন্তু নেহেরুর কোনো প্রলোভনের ফাঁদেই পা দেননি সুরেশচন্দ্র । আর নেহেরু তার এই সমস্ত কুকীর্তি শাহনওয়াজ খানকে মাধ্যম করে চালিয়ে গিয়েছিলেন৷ এখানে আরও একটা কথা না বললেই নয় যে, বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন আদপে বিশ্বস্ত সাগরেদ। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি নেতাজীর মত এক মহান দেশপ্রেমিকের বিরুদ্ধে চলা ষড়যন্ত্রে সমান অংশভাগী ছিলেন । কিন্তু শাহনওয়াজ খানের সঙ্গে তার পার্থক্য হল যে বিধানচন্দ্র কোনো দিনই আজাদ হিন্দ ফৌজের অংশ ছিলেন না বা নেতাজীর আন্দোলনকে তিনি প্রকাশ্যে কোনো দিন সমর্থন করেননি৷
ইতিহাসের পাতা ওল্টালে জানতে পারা যায় যে, মেজর জেনারেল শাহনাওয়াজ খানের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ১৯৪৪ সালে ভারতীয় সীমান্তের কাছে ব্রিটিশ সৈন্যদের পরাজিত করে। তবে এই বিজয়ের আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেনি কারণ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে জাপান ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীকে তাদের নিজস্ব ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়। সেই সংকটময় পরিস্থিতিতে, মেজর জেনারেল শাহ নওয়াজ ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তার সৈন্যদের নেতৃত্ব দেন।সেই যুদ্ধে ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর বিরাট ক্ষতি হয়। বেশিরভাগ সৈন্য প্রাণ হারায় এবং শাহনওয়াজ সহ বাকি সৈন্যদের ১৩ মে ১৯৪৫ সালে আটক করা হয়। ব্রিটিশ সরকার তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনে এবং ৫ নভেম্বর ১৯৪৫ সালে দিল্লির লাল কেল্লায় একটি বিচার পরিচালনা করে ।
সেই বিচার চলাকালীন, মুসলিম লীগের নেতা মহম্মদ আলী জিন্নাহ কেবল শাহনওয়াজের পক্ষে সওয়াল করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু, শাহনওয়াজ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন । অবশেষে, ব্রিটিশ সরকার তাকে নির্বাসনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারনে তাকে মুক্তি দেওয়া হয় । পরে সেই বিচার চলাকালীন তিনি জওহরলাল নেহেরু সহ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এর ফলে তিনি পরবর্তী পর্যায়ে কংগ্রেসে যোগদান করেন । তারপরেই শুরু হয় নেতাজীকে মৃত প্রমান করার ষড়যন্ত্র ।
কিন্তু, যার ভয়ে ব্রিটিশরা পালিয়েছিল, গান্ধী- নেহেরুর মরার পরেও যাকে আজও মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন, সেই নেতাজীকে সামনে রেখে শাহনওয়াজ যদি আজাদ হিন্দ ফৌজকে ফের সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতেন তাহলে স্বাধীনতা উত্তর ভারতের ছবি অন্য রকম হতে পারত । নেতাজীর পাশাপাশি তাঁকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করত মানুষ ।
কিন্তু শাহনাওয়াজ সেই নেহেরুর সাথ দিয়েছিলেন যিনি ঘোষনা করেছিলেন যে “আজাদ হিন্দ ফৌজের কোনো সৈনিককে পরবর্তী ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নেওয়া হবে না” এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আজাদ হিন্দ সৈনিকদের “গ্রামে গিয়ে চাষবাস করার” উপদেশ দিয়েছিলেন । তার আগে আজাদ হিন্দ ফৌজকে “জোকার” বলেছিলেন গান্ধী । পরে নেতাজির একটা সৈনিককেও পরবর্তী ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়নি। কিন্তু শাহনাওয়াজকে মন্ত্রীসভায় এনেছিল নেহেরু । ব্রিটিশ অনুগত গান্ধী ও নেহেরুর প্রকৃত স্বরূপ আজ একটু একটু করে উন্মোচিত হচ্ছে৷ পাশাপাশি বীরের তকমা দেওয়া শাহনাওয়াজ খানের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কেও মানুষের অবগত হওয়া প্রয়োজন ।।

