জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,০৪ জুন : প্রথমে সিপিএম ও পরে তৃণমূলের সঙ্গে আপোষহীন লড়াই করে এইবঙ্গে কিছুটা হলেও কংগ্রেসকে যিনি প্রাসঙ্গিক করে রেখেছিলেন তার নাম অবশ্যই অধীর রঞ্জন চৌধুরী। একটু গম্ভীর ভাবে বিচার করলে দেখা যাবে তার পরাজয়েই পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হলো। সমগ্র রাজ্য থেকে কংগ্রেসের অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে গেলেও মূলত তার জন্যেই মুর্শিদাবাদকে কংগ্রেস তথা অধীরের গড় বলা হতো। আজ সেই গড়েই তিনি পরাজিত এবং হারলেন রাজনীতিতে নবাগত ‘বহিরাগত’ ইউসুফ পাঠানের কাছে। রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অনেক সময় অভিজ্ঞ ও তৃণমূল স্তরের রাজনৈতিক নেতারাও দেওয়াল লিখন পড়তে ভুল করেন। যে ভুলটা করলেন অধীর চৌধুরী। যেমন ২০০১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে করেছিলেন মমতা ব্যানার্জ্জী।
যাইহোক, মমতার ব্যানার্জ্জীর বরাবরের লক্ষ্য মার্কসবাদী কংগ্রেস নেতাদের পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া। মূলত ওদের সঙ্গে ‘সেটিং’ করেই বামফ্রন্ট এই রাজ্যে ৩৪ বছর রাজত্ব করে গেছে বলে অভিযোগ উঠত । এমনকি কংগ্রেস কর্মীদের উপর অত্যাচারের বুলডোজার চালিয়ে গেছে। সেইসময় কংগ্রেসে বাঘা বাঘা নেতা থাকলেও কেউই কিন্তু সিপিএমের অত্যাচারের শিকার কংগ্রেস কর্মীদের পাশে দাঁড়ায়নি। সেই সময়ে কংগ্রেস সম্পর্কে একটা কথা বহুল প্রচলিত ছিল-“তরমুজ” । অর্থাৎ ভিতরে লাল এবং উপরে সবুজ । সিপিএমের শত অত্যাচার সত্ত্বেও সৌমেন মিত্র,প্রনব মুখার্জি, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সিদের মুখে প্রতিবাদের ভাষা ছিল না ।
কিন্তু অধীর চৌধুরী তো ওদের মত নন। সিপিএমের শত অত্যাচার সহ্য করেও তিনি মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের একটা শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নিজের একটা ‘পজিশন’ করেছিলেন। অথচ নিজের ভুলে জীবনের শেষ নির্বাচনে নিজেকে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেললেন। ফিরে আসার লড়াইয়ে তার বয়স একটা বড় ফ্যাক্টর। কোনো অঘটন না ঘটলে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন ২০২৯ সালে হবে এবং তখন তার বয়স হবে ৭৪ বছর। অবশ্য তার মত লড়াকু নেতার কাছে বয়স কোনো ফ্যাক্টর না হতেও পারে।
ভাবা যায় ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের সময় সদ্য গড়ে ওঠা আইএসএফের আব্বাস সিদ্দিকীর দাবি তাদের ইচ্ছেমত জোট হবে। হলে হয়তো আর একটা ঐতিহাসিক ভুল হতো ! যদিও আসন সমঝোতার কারনে সেই জোট হয়নি। এখন আব্বাসের নাম শোনা যায় না, একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও, যতদিন এইদেশে গণতন্ত্র থাকবে ততদিন অধীরের নাম উচ্চারিত হবে। এখনো যারা কংগ্রেসকে ভোট দেয় সেদিন তারা অধীরের প্রাথমিক ভূমিকা মানতে পারেনি।
যেমন মানতে পারেনি ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের সময় তার ভূমিকাকে। কংগ্রেসের কট্টর বিরোধী আম আদমি পার্টির (আপ) সঙ্গে দিল্লি ও পাঞ্জাবে আসন রফা হলেও তার জিদের জন্য এই রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের আসন রফা হয়নি। যেটা বিগত বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে প্রিয়াঙ্কা বা বিহারে রাহুল করেছিল। ফল সবার জানা।
এবার সেই ভুলটা এই রাজ্যে অধীর করলেন বলে মনে করছে অভিজ্ঞ মহল । তিনি কংগ্রেসের বর্তমান ক্ষমতা বুঝতে পারেনি এবং সিপিএমের সম্পর্কে তার মূল্যায়ন সম্পূর্ণ ভুল ছিল। কেরল বা আসামে কংগ্রেসের বিরোধিতা করলেও সিপিএমের লক্ষ্য কোনো রকমে রাজ্য রাজনীতিতে আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা। তার জন্য কংগ্রেসের হাত ধরতে তাদের কোনো দ্বিধা ছিলনা। এবার সিপিএম হয়তো কেরলেও কংগ্রেসের সঙ্গে আসন রফা করবে! সিপিএমের সঙ্গে আসন রফা করাটা অনেক কংগ্রেস কর্মীরাও মেনে নিতে পারেনি।
এখন প্রশ্ন হলো, এরপর অধীর কি করবেন ? তিনি কি বিজেপিতে যোগ দিয়ে রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার চেষ্টা করবেন ? নাকি নতুন করে লড়াই শুরু করবেন ? এটা জানার জন্য একটু অপেক্ষা করতেই হবে। তবে তার মত বর্ণময় রাজনৈতিক নেতাকে অবশ্যই তার দলের সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রয়োজন।।