এইদিন ওয়েবডেস্ক,মঙ্গলকোট(পূর্ব বর্ধমান),০৭ জানুয়ারী : গ্রামবাসীদের একাংশকে দস্যুবৃত্তি থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব । তাঁর এই নির্দেশ মেনে অতীতের সিদ্ধলগ্রাম অধুনা শীতলগ্রামে থেকে গিয়েছিলেন মহাপ্রভুর প্রিয় পার্ষদ ধনঞ্জয় পন্ডিত । পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট ব্লকের কৈচর অঞ্চলের অন্তর্গত শীতলগ্রামে আজও রয়েছে মহাপ্রভুর স্মৃতি বিজড়িত ধনঞ্জয় পন্ডিতের গোপীনাথ মন্দির । মন্দিরের পাশেই রয়েছে ধনঞ্জয় পন্ডিতের সমাধি । প্রচারের অভাবে কার্যত লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে পাঁচ শতাধিক বর্ষ প্রাচীন ঐতিহ্যময় এই বৈষ্ণব পীঠটি । এনিয়ে চাপা ক্ষোভও রয়েছে গ্রামবাসীদের মনে ।
প্রাচীন পুঁথি থেকে জানা যায়, ১৪৮৫ খ্রীষ্টাব্দ বা বাংলার ১৩০৬ সালে চৈত্রী শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার জারগ্রামে জন্ম গ্রহন করেন ধনঞ্জয় পন্ডিত । বাবা শ্রীপতি বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা কালিন্দীদেবী দু’জনেই ধার্মিক প্রকৃতির ছিলেন । ছোট বেলা থেকেই তার প্রভাব পড়েছিল শিশু ধনঞ্জয়ের উপর । কৈশোর অবস্থাতেই হরিপ্রিয়া নামে স্থানীয় এক কিশোরীর সঙ্গে ধনঞ্জয় পন্ডিতের বিবাহ দিয়ে দেন তাঁর বাবা-মা । কিন্তু বিয়ের কিছু দিন পরেই তীর্থ যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নবদ্বীপে চলে আসেন তিনি । সেখানে গৌর ও নিতাইয়ের সঙ্গলাভ হয় । তারপর নিত্যানন্দ প্রভুর কাছে দীক্ষা গ্রহন করেন কিশোর ধনঞ্জয় । গৌরগণোদ্দেশ দিপীকায় বর্নিত আছে : “বসুদাম সখায়শ্চ পন্ডিতঃ শ্রীধনঞ্জয়।” অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরামের প্রিয় পার্ষদ দ্বাদশ গোপালের অন্যতম সখা বসুদাম হিসাবেই ধনঞ্জয় পন্ডিতকে মনে করেন বৈষ্ণবরা ।
ধনঞ্জয় পন্ডিতের শীতলগ্রামে আগমনের পিছনে গ্রামবাসীদের মধ্যে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে । যা মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের দেবের নীলাচলে যাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত । এনিয়ে শীতলগ্রামের বাসিন্দা বিকাশ হাজরা বলেন, ‘বাবা-ঠাকুরদার কাছ থেকে শুনেছি শীতলগ্রামে দুটি গোষ্ঠী ছিল যাদের পেশা ছিল ডাকাতি করা । ওই দুই ডাকাতদল গ্রামে সিদ্ধেশ্বরী দেবীর প্রতিষ্ঠা করেন । মন্দির নির্মানও করা হয় । রোজ রাতে দেবীর পুজো করে তারা ডাকাতি করতে বেরুতো । শীতলগ্রামের মাঠের মাঝে ধুরো পুকুর পাড়ে ছিল তাদের ঠেক । পথচারীদের আটকে তাঁরা লুটপাট চালাতো ।’
বিকাশবাবু বলেন, ‘এদিকে মহাপ্রভু সবে সন্ন্যাস গ্রহন করেছেন । সন্ন্যাস নেওয়ার পর সপার্ষদ খোল করতাল বাজিয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে কাটোয়া থেকে পায়ে হেঁটে তিনি নীলাচলের উদ্দেশ্যে রওনা হন । কিন্তু শীতলগ্রামের ধুরো পুকুর পাড়ের কাছে আসতেই আমাদের গ্রামের ডাকাতদল তাঁদের পথ আটকায় । ডাকাতরা ভেবেছিল খোলের ভিতরে টাকা-পয়সা, সোনা-দানা ভরে নিয়ে যাচ্ছে সন্নাস্যীরা । তখন ডাকাত সর্দার লাঠি নিয়ে মহাপ্রভুর গলায় ঝোলানো খোল ভাঙতে উদ্যত হয় । কিন্তু সে উর্ধবাহুই থেকে যায় । লাঠি চালাতে ব্যার্থ হয় ডাকাত সর্দার । মহাপ্রভুর এই অলৌকিক ক্ষমতা দেখে তাঁর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে ডাকাত সর্দার ও তাঁর দলবল । তারপর তারাঁ মহাপ্রভু ও তাঁর পার্ষদদের সসম্মানে শীতলগ্রামে নিয়ে আসেন । সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের কিছুটা পাশে একটা গুলঞ্চ গাছ ছিল । ওই গাছের নিচেই বসানো হয় সন্নাস্যীদের । তারপর সযত্নে অতিথি সৎকার করে ডাকাতদল।
তিনি বলেন, ‘শুনেছি ২ দিন শীতলগ্রামে ছিলেন মহাপ্রভু । তৃতীয় দিন তিনি নীলাচলের উদ্দেশ্যে রওনা হন । কিন্তু যাবার আগে তিনি গ্রামের লোকজনদের দস্যুবৃত্তি থেকে স্বাভবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার ভার ধনঞ্জয় পন্ডিতের উপর দিয়ে যান । প্রিয় পার্ষদের আগ্রহে নিমকাঠের রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি তৈরি করে দিয়ে যান মহাপ্রভু । পরে ধনঞ্জয় পন্ডিত নিম কাঠের তৈরি মহাপ্রভুর একটা অবয়ব তৈরি করান । যে গুলঞ্চ গাছের নিজে মহাপ্রভুকে বসানো হয়েছিল সেখানে তৈরি করান গোপীনাথ মন্দির । গ্রামবাসীদের শিক্ষাদান আর পূজার্চনার মধ্য দিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন ধনঞ্জয় পন্ডিত।’
পুরনো নথি থেকে জানা যায়,শীতলগ্রামে আসার কিছুদিন পর বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার প্রসারের জন্য সাঁচড়া-পাঁচড়া হয়ে বৃন্দাবনে যান ধনঞ্জয় পন্ডিত । সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে জলন্দি গ্রামে আসেন । তারপর ফের তিনি শীতলগ্রামে ফিরে আসেন । জীবিতবস্থায় চারটি শ্রীপাট প্রতিষ্ঠা করেন এই বৈষ্ণব সাধক । ওই চার শ্রীপাট হল সাঁচড়া,পাঁচড়া, জলন্দী ও শীতলগ্রাম । আনুমানিক চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগে শীতলগ্রামেই দেহত্যাগ করেন ধনঞ্জয় পন্ডিত । গোপীনাথ মন্দিরের পাশেই তাঁকে সমাধীস্ত করা হয় বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা । জানা গেছে, যে গুলঞ্চ গাছের নিচে মহাপ্রভুকে বসিয়ে অতিথি সৎকার করেছিল ডাকাতদল কিছু দিন আগে পর্যন্তও সেই গাছের অস্তিত্ব ছিল । কিন্তু মন্দিরের পুঃনির্মানের কাজ করতে গিয়ে পাঁচ শতাধিক বর্ষ প্রাচীন ওই গাছটি কাটা পড়ে যায় ।
যদিও ধনঞ্জয় পন্ডিতের শীতলগ্রামে আসার যে কাহিনী গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রচলিত আছে তা সঠিক নয় বলে মনে করেন ঐতিহাসিক তথা লেখক রনদেব মুখোপাধ্যায় । তিনি বলেন, ‘মহাপ্রভুর সঙ্গে ধনঞ্জয় পন্ডিতের সাক্ষাৎ হয়েছিল বলে প্রাচীন কোনও পুঁথিতে উল্লেখ নেই । তবে নিত্যানন্দের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল । নিত্যানন্দের দ্বাদশ গোপালের অন্যতম গোপাল ছিলেন ধনঞ্জয় পন্ডিত ।’ পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘শুধু ধনঞ্জয় পন্ডিতের শ্রীপাটই নয় রাজা লক্ষন সেনের পরামর্শ দাতা তথা মন্ত্রী ভবদেব ভট্টের জন্ম সিদ্ধল বা শীতলগ্রামেই হয়েছিল বলে মনে করা হয় । যে ভবদেব ভট্টের নির্ণীত পরিসংখ্যান অনুসারে হিন্দু শাস্ত্রের তিথি,নক্ষত্র এমনকি দুর্গাপূজার নির্ঘন্ট আজও মেনে চলা হয় । সেই দিক থেকে শীতলগ্রামের একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে ।’
শীতলগ্রামের সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের কিছুটা পাশেই রয়েছে গোপীনাথ মন্দির । ধনঞ্জয় পন্ডিতের মৃত্যুর পর থেকে বংশানুক্রমিকভাবে বিগ্রহের নিত্য সেবার দায়িত্ব পালন করে আসছে শীতলগ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায়,চট্টোপাধ্যায় ও মুখোপাধ্যায় পরিবার । বর্তমানে ৮০ জন সেবাইত রয়েছেন । জমিদারের কাছ থেকে পাওয়া কিছু জমিজমাও রয়েছে । তা থেকেই চলে নিত্যসেবার খরচ ।
গোপিনাথ মন্দিরের সেবাইত অজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘রাস পূর্নীমা, জন্মাষ্টমী ও দোল যাত্রায় ধুমধাম সহকারে পূজার্চনার আয়োজন করা হয় । তবে ধুমধাম বেশি হয় ১৪ ই মাঘ । ওই দিনটি ধনঞ্জয় পন্ডিতের তিরোধান দিবস হিসাবে পালন করা হয় । ওই দিন রাধাকৃষ্ণ ও মহাপ্রভুর বিগ্রহকে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের কাছে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় । চিঁড়ে মচ্ছবের আয়োজন করা হয় । পরের দিন হয় অন্ন মচ্ছব । শেষে ১৬ তারিখে বিগ্রহ ফের গোপীনাথ মন্দিরে আনা হয় । সেই উপলক্ষে মহোৎসবের আয়োজন হয় । তিন চার দিন ধরে মেলা চলে । আশপাশের বেশ কিছু গ্রামের মানুষ উৎসবে সামিল হন ।’
বিকাশ হাজরা ও অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়রা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘শীতলগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গোপীনাথ মন্দিরের ইতিহাস সর্বসমক্ষে তুলে ধরার জন্য প্রশাসনিকভাবে কোনও চেষ্টাই করা হয়নি । এমনকি কাটোয়া মহকুমা এলাকার প্রাচীন স্থানগুলো নিয়ে যে ইকো ট্যুরিজম ঘোষনা করেছে প্রশাসন সেই তালিকাতে পর্যন্ত ঠাঁই দেওয়া হয়নি শীতলগ্রামের গোপীনাথ মন্দিরকে । এছাড়া শতাব্দী প্রাচীন মন্দির ভবনটি জরাজীর্ন হয়ে গিয়েছিল । নতুন মন্দির নির্মানের জন্য সরকারি সহায়তা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । শেষে গোপীনাথের অন্যতম সেবাইত দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অর্থানুকুল্যে মাস দুয়েক আগে মন্দিরটিকে পুঃনির্মান করা হয় ।’
এই বিষয়ে রনদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘একথা অনস্বীকার্য যে শীতলগ্রাম বৈষ্ণবদের একটা পীঠ রয়েছে । যাঁরা এনিয়ে চর্চা করেন একমাত্র তাঁরাই জানেন শীতলগ্রামে ধনঞ্জয় পন্ডিতের শ্রীপাট সম্পর্কে । স্থানীয় অধিকাংশ মানুষ এই পীঠ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ । গোপীনাথ মন্দিরের সেবাইতদের উচিত প্রাচীন এই শ্রীপাটের ইতিহাস সর্বসমক্ষে আনা ।’।