এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,২৯ ডিসেম্বর : ফি বছর বর্ষাকালে বন্যার জলে একের পর এক বাড়ি, স্বজন গবাদী পশু তলিয়ে যাওয়া ঘাটালবাসীর কার্যত বিধিলিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে । তারপরেই শুরু হয় ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ নিয়ে জোর চর্চা । বর্ষা শেষ হলেই ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’-এর কথা বেমালুম ভুলে যান রাজনৈতিক নেতারা । কিন্তু কোনো ভোট এলেই প্রতিটি জনসভায় নেতারা ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন ৷ বিগত লোকসভা নির্বাচনে এমনই প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় । তিনি গত ৭ এপ্রিল একটা জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন,৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু হবে এবং এর জন্য রাজ্য সরকার ১,৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করবে। কিন্তু আজ ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’-এর কাজ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই পড়ে আছে ।
অভিষেক ব্যানার্জির সেই প্রতিশ্রুতির ভিডিও এক্স-এ শেয়ার করে রাজ্য বিজেপির যুবমোর্চার সহ সভাপতি তথা কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী তরুনজ্যোতি তিওয়ারি ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’-এর কাজ না হওয়ায় রাজ্যের শাসকদলকেই দোষারোপ করেছেন। প্রথমে তিনি অভিষেক ব্যানার্জি, ঘাটালের সাংসদ অভিনেতা দেবকান্ত অধিকারী বা দেবসহ তৃণমূল নেতাদের প্রতিশ্রুতির পরিসংখ্যান তুলে ধরে লিখেছেন,’ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান : ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ আসতে আর কতদিন বাকি ? ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল অঞ্চলের বন্যা সমস্যার সমাধানের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত একটি প্রকল্প। তৃণমূল কংগ্রেস বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারের সময় এই প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নিচে নির্বাচনী সময়সূচী অনুযায়ী তৃণমূল নেতাদের প্রতিশ্রুতির তারিখসমূহ উল্লেখ করা হলো:
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি ছিল ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন: ২০১৪ সালের এপ্রিল-মে: এই সময়ে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী দীপক অধিকারী (দেব) ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালান।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন: ২০১৬ সালের মার্চ-এপ্রিল:তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন: ২০১৯ সালের মার্চ-এপ্রিল: পুনরায় প্রার্থী হওয়া দীপক অধিকারী (দেব) ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেন।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন: ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিল: তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন: ২০২৪ সালের ৭ এপ্রিল: তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটালে এক নির্বাচনী সভায় ঘোষণা করেন যে, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু হবে এবং এর জন্য রাজ্য সরকার ১,৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করবে।
২০২৪ সালের জুলাই: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন যে, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ আগামী দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে এবং রাজ্য সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর: সাংসদ দীপক অধিকারী (দেব) জানান যে, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু হতে চার-পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।’
তরুনজ্যোতির কথায়,’এই ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানকে তৃণমূল মোটামুটি ঘাটালের মানুষদের বোকা বানানোর মাস্টার প্ল্যান হিসেবে ব্যবহার করে। একের পর এক নির্বাচনেরা যেতে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হয় না।’
এই প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকেই দায়ি করেছেন তরুনজ্যোতি তিওয়ারি । তিনি লিখেছেন,’প্রকল্পটি পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হলে ঘাটাল-সহ আশপাশের অঞ্চলগুলিতে বন্যার প্রভাব কমানো সম্ভব হতো। কিন্তু দীর্ঘ এক দশক ধরে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হতে দেরি হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদাসীনতা এবং পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করা হচ্ছে।’ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন,’কেন্দ্র সরকার ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য ৬০:৪০ অনুপাতে কেন্দ্র-রাজ্য অর্থায়নের প্রস্তাব করেছিল। ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পের জন্য ১,৫০০ কোটি টাকার একটি সম্ভাব্য বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়।কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রণালয় পার্লামেন্টে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সদর্থক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। তবে, রাজ্যের পক্ষ থেকে বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট (Detailed Project Report বা DPR) কেন্দ্রে জমা পড়েনি।’
তরুনজ্যোতির অভিযোগ,’পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্তারিত পরিকল্পনা কেন্দ্রে জমা দিতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। DPR জমা না হওয়ার ফলে প্রকল্পের অনুমোদন এবং অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া আটকে রয়েছে।পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের উপর দোষ চাপিয়ে দাবি করেছে যে, কেন্দ্র ইচ্ছাকৃতভাবে এই প্রকল্পে সহযোগিতা করছে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, রাজ্য সরকার প্রয়োজনীয় নথি এবং পরিকল্পনা জমা দেয়নি।’
বিজেপির এই যুবনেতার কথায়,’ঘাটাল এবং আশপাশের অঞ্চলের মানুষ প্রতিবার বন্যার সময় ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হন। তারা বহু বছর ধরে এই প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি শুনছেন, কিন্তু বাস্তবে কাজের কোনো অগ্রগতি দেখেননি। ঘাটালের সাংসদ দীপক অধিকারী এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান এর কথা বলে তিনবার নির্বাচন জিতলেন কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প শুধুমাত্র রাজনীতি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে আটকে থাকা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হওয়ার জন্য রাজ্যের দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা স্পষ্ট। যদি রাজ্য সরকার প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় DPR দ্রুত কেন্দ্রে জমা দেয়, তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব। দীর্ঘমেয়াদী বন্যা সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক মতবিরোধ পেরিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ অত্যন্ত প্রয়োজন।’ পরিশেষে তিনি লিখেছেন, ‘জনগণের উন্নয়ন রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকা উচিত।’।