প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৮ জানুয়ারি : এ যেন বাংলার এক নেই গ্রাম ,কিছুই না পাওয়া একটা গ্রাম।এখানে কোন কলকারখানাও নেই,একশো দিনের কাজও নেই।এই গ্রামে আছে বলতে শুধু সারিসারি মাটির বাড়ি, বন জঙ্গল ,গাছের ডাল আর গাছের পাতা।প্রাকৃতিক এই সম্পদ টুকুই পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের সখাডাঙ্গা ও মাঝেরডাঙ্গা গ্রামের তপশিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের অন্ন সংস্থানের একমাত্র ভরসা।কেন্দ্র বা রাজ্য,কোন সরকারের প্রতিনিধিরাই নাকি কিছু না পাওয়া এইসব গ্রামের বাসিন্দাদের কোন খোঁজও নেন না।নিদারুন কষ্টে দিন যাপন করা এখানকার গ্রামগুলির মানুষজন তাই সরকারী আবাস যোজনার পাকা বাড়ি পাবার আশাও করেন না।তাঁদের সুদিন ফেরাতে কবে সরকার বা প্রশাসন উদ্যোগী হবে,তাও এখানকার বাসিন্দাদের কাছে অজানাই রয়ে আছে।
জঙ্গল মহল হিসাবেই পরিচিত আউশগ্রাম। এখানকার সখাডাঙ্গা ও মাঝেরডাঙ্গা ছাড়াও বাবুইশোল,ভাতকুন্ডা,প্রেমগঞ্জ,প্রতাপপুর,
জরকাডাঙা, কুচিডাঙা,অমরপুর,আদুরিয়া, জালিকাঁদর,জামতারা দেবশালা এবং ভাল্কি সহ প্রায় ৩০ টি গ্রাম জঙ্গলমহল এলাকার মধ্যে রয়েছে ।গ্রামগুলিতে মূলত তফশিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষজন বসবাস করেন।মাটির বাড়িতে বসবাস করা গুলির সিংহভাগ পরিবারেরই মূল পেশা খেতমজুরি।তবে সেই কাজ সারা বছরে মধ্যে মাত্র কয়েক মাস তাঁদের মেলে।বাকি দিন গুলিতে এইসব গ্রামের মানুষজনের রোজগারের ভরসা বলতে ছিল একশো দিনের কাজ,জঙ্গলের গাছের ডাল ও পাতা। আমন ধান গাছ কাটা ও ঝাড়ার কাজে এখন চাষিরা যন্ত্রের ব্যবহারই বেশী করছেন। তাই এখন খেত মজুরির কাজও তাঁদের তেমন খুব একটা মিলছে না।এদিকে ১০০ দিনের কাজও দীর্ঘ দিন বন্ধ।এই অবস্থায় সংসার চালাতে জঙ্গলে থাকা গাছের ডালপালা এবং শাল গাছ ও খেজুর গাছের পাতাই তাঁদের প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে।এহেন দরিদ্র পরিবারের কর্তারা তাই তাঁদের বাড়ির বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো ও পড়াশুনা করানোটা বিলাশিতা ছাড়া আর কিছু নয় বলেই মনে করেন।
আউশগ্রামে সখাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা বাসন্তী বাস্কে বলেন,“যখন একশ দিনের কাজ ছিল তখন হাতে কিছু পয়সা আসতো। সংসার চালানোর কষ্ট একটু লাঘব হত। কিন্তু অনেক দিন হয়েগেল একশ দিনের কাজ বন্ধ রয়েছে। ধান গাছ কাটা ও ঝাড়ার কাজে এখন যন্ত্রের ব্যবহারও বেড়ে গেছে। তাই ধান গাছ জমিতে পোঁতা আর কাটা ঝাড়ার কাজ এখন বছরে মাত্র ২৫-৩০ দিন মেলে।বাকি বছরের পুরো সময়টা আমাদের জঙ্গলের ওপরেই ভরসা রাখতে হয়। বাসন্তীদেবী বলেন,শালপাতা ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে আমরা জঙ্গলে যাই। সেখান থেকে শালপাতা ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসি। পরে পরিবারের সবাই মিলে শালপাতা দিয়ে থালা তৈরি করে রোদে শুকিয়ে বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যান । কখনও কখনও পাইকেররাও বাড়ি এসে আমাদের কাছ থেকে শাল পাতার থালা নিয়ে যায়।এক হাজার থালার মূল্য বাবদ দেড়শো টাকা পান।এছাড়াও জ্বালানি কাঠ বাজারে বিক্রি করে কিছু অর্থ উপার্জন করেন। সামান্য এইটুকু রোজগারের উপরে ভরসা করেই কোন রকমে অন্নের সংস্থান টুকু হয় বলে বাসস্তী বাস্কে জানয়েছেন ।
অপর বাসিন্দা সনকা বাউরি ,সুমি সোরেন বলেন,
সারাদিন ধরে জঙ্গলে শাল পাতা ও খেজুর পাতা সংগ্রহ করে তা বাড়িতে আনতে মোটরভ্যানে ১০০ টাকা ভাড়া লাগে । ঝাঁটা তৈরির জন্য খেঁজুর পাতা চাঁছা ছোলা করতে অনেক সময় লাগে। পরিবারের পুরুষ,মহিলা এমনকি শিশু কিশোররাও এই কাজ করে। তারপর ঝাঁটা তৈরি করা হয় । এই কাজে প্রচুর পরিশ্রম । খরচও আছে । আমরা নিজেরা কায়িক পরিশ্রম করি বলে পুষিয়ে যায় ।’১২ টি ঝাঁটার একটি বান্ডিল বিক্রি হয় ৩০০ টাকায় ।একই ভাবে শাল পাতার থালা বোনার পর টানা দু’তিন দিন ধরে ওই থালা রোদে শুকাতে হয় । এক হাজার পিস সেই থালা বাজারে বিক্রী করে মাত্র ১৫০ টাকা দাম পাই । তাতে কি সংসার চলে ? কিন্তু কি আর করার আছে ! এই ভাবেই চালাতে হচ্ছে ।পরিবারের কারুর কঠিন রোগব্যাধি হলে তখন দুশ্চিন্তার পাহাড় যেন মাথায় ভেঙে পড়ে। আক্ষেপ প্রকাশ করে সুমিদেবী বলেন,’আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি সহায়তা পাইনি ।আমাদের গ্রামের কেউ মাটির ঘরে, আবার কেউ এক কুঠুরি কুঁড়ে ঘরে বসবাস করে ।সরকারি ঘর পাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয় নি। আর আদৌ কোনদিন হবে কিনা তাও জানা নেই!
এইসব গ্রাম গুলির মানুষদের দুরাবস্থার কারণ বিষয়ে বিডিও (আউশগ্রাম ১ ব্লক) অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,“কেন্দ্রের তরফে (সেন্ট্রাল পোর্টালে) এখনও আউশগ্রাম বাসীর বাড়ি পাবার ছাড়পত্র দেয় নি ।
দিলে তবে তো বাড়ি পাওয়া না পাওয়ার প্রশ্ন আসবে।বিডিও এও জানান ,আবাস যোজনার সরকারী বাড়ির জন্য আমাদের ব্লকে সাড়ে চার হাজর জন বাসিন্দার নাম আপলোড করা আছে।
কিন্তু গোটা ব্লকের জন্য ছাড়পত্র মিলেছে মাত্র ১১ টি বাড়ির । তবে ব্লক থেকে আড়াই হাজার জনকে বিধবা ভাতা ও ৬ হাজার জনকে ,বার্ধক্য ভাতা দেওয়ার জন্য কাজ হচ্ছে। এইসব ভাতা পাবার জন্য আরো কেউ যদি আবেদন করেন তাঁদের জন্যও ব্যবস্থা করা হবে বলে বিডিও জানিয়েছেন
। আউশগ্রামের বিধায়ক অভেদানন্দ থান্ডার বলেন,“সরকারী আবাস যোজনার বাড়ি নিয়ে আউশগ্রাম ২ ব্লকের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা তৈরি না হলেও আউশগ্রাম ১ ব্লকের ক্ষেত্রে হয়েছে। বিষয়টি তিনি রাজ্য সরকারকে জানিয়েছেন। রাজ্য সরকার এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় যা ব্যবস্থা নেওয়ার নিচ্ছে ।’।