প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৫ ফেব্রুয়ারী :
বেপরোয়া বালি কারবারীদের দৌরাত্ম্যে বিপন্ন দামোদরের গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ।যা চোখে পড়তেই প্লাবন মরশুমে বড়সড় বিপর্যয়ের আশঙ্কায় তটস্থ সেচ দফতর।এমন পরিস্থিতিতে পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের বাঁধের উপর দিয়ে বালি বোঝাই ভারী যানবাহন চলচল আটকানোই এখন সেচ দফতরের কাছে বড় চ্যালেঞ্জের।তাই এ বিষয়ে
কঠোর পদক্ষেপ গ্রহনের জন্যে সেচ দফতর জেলা ও ব্লকের সকল স্তরের প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে আবেদন জানিয়েছে।যদিও প্রশাসনের ভরসায় না থেকে বাঁধ রক্ষার্থে এখন থেকেই একাট্টা হয়েছেন জামালপুর দাদপুর, সারাংপুর ও হাবাসপুর গ্রামের বাসিন্দারা।
নদ-নদী থেকে বালি লুট হওয়াটা পূর্ব বর্ধমান জেলায় নতুন কোন ঘটনা নয় । তবে বালি কারবারীদের দৌরাত্ম্যে দামোদরের গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ বিপন্ন হয়ে পড়াটা কার্যতই নজিরবিহীন।তাই প্লাবন মরশুমে কি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে,তা ভেবেই এখন শঙ্কিত দামোদর তীরবর্তী গ্রাম গুলির বাসিন্দারা।এমনকি তাঁরা ক্ষোভেও ফুঁষছেন।তাদের সেই ক্ষোভের বহিপ্রকাশও মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে।বাঁধের উপর দিয়ে বালি বোঝাই কোন ভারী যানবাহন গেলেই দাদপুর, সারাংপুর ও হাবাসপুর গ্রামের বাসিন্দারই রুখে দাঁড়াচ্ছেন।
দাদপুর গ্রামেই বসবাস করেন দামোদরের বাঁধ রক্ষা কমিটির অন্যতম নেতা তথা পাঁচরা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান অশোক দাস। তিনি বলেন,“জামালপুরের পুলমাথা থেকে শুরুকরে বর্ধমান ২ ব্লকের বড়শুল পর্যন্ত দামোদরের বাম দিকের বাঁধ (Left Embankment)’ভারত রক্ষা আইনের’ আওতাভুক্ত।গুরুত্বপূর্ণ এই বাঁধের উপর দিয়ে কোন প্রকার ভারী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেচ দফতরের।তা সত্ত্বেও দৌরাত্ম্য বন্ধ করেনা বালি কারবারীরা।সেই কারণে বালি বোঝাই ভারী যানবাহনের দাপট থেকেও বাঁধ মুক্তি হতে পারছেনা”।অশোক বাবুর কথায়,“বালি কারবারীদের দৌরাত্ম্য প্রদর্শন শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে নি।অসাধু বালি কারবারীরা তাদের বালির গাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে বাঁধের ক্ষতি করে রাস্তা (Crossing Point)তৈরি করতেও দ্বিধা বোধ করে নি।দাদপুর,সারাংপুর ও হাবাসপুর এলাকা মিলিয়ে প্রায় ২ কিলোমিটার বাঁধের অংশের একাধীক জায়গাকেই তারা ক্রসিং পয়েন্টের জন্য বেছে নেয়।নিজেদের ক্ষমতা দেখিয়ে বালি কারবারীরা ’ক্রসিং পয়েন্ট’ গুলি তৈরি করে।সেইসব ক্রসিং পয়েন্ট গুলিও বাঁধের ক্ষতির অন্যতম কারণ ।
দামোদরের বাঁধ রক্ষা কমিটির নেতা অশোক দাস তাঁর অভিযোগে আরও বলেন ,“সেচ দফতর
উদ্বেগ প্রকাশ করার পরেও বাঁধের উপর দিয়ে বালি বোঝাই ভারী যানবাহনে চলাচলে পুরোপুরি লাগাম পড়েনি।গভীর রাতে বাঁধে নজর রাখলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।এই কারণে বাঁধের আরো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।সেচ দফতরের আধিকারিকরা নিজেরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন,’বালি বোঝাই ভারী যানবাহন (Tractor) চলাচলের কারণে সালালপুর শ্মশানঘাট থেকে সারাংপুর পর্যন্ত বাঁধ(Left Embankment)খুবই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।তা নিয়ে সেচ দফতরের সাবডিভিশনাল (ইদিলপুর ১) অফিসাররা যথেষ্টই চিন্তিত ।’ বাঁধের উপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহনের জন্যে তারা ইতিমধ্যেই জেলার ভূমি দফতর সহ ব্লক প্রশাসনের নানা মহলে চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়েছে ।
এ নিয়ে সেচ দফতরের সাব-ডিভিশনাল অফিসের(ইদিলপুর ১) আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও বাঁধের দুরাবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কোন রাখঢাক না রেখেই তারা বলেন,বালি বোঝাই ভারী যানবাহন যাতায়াতের কারণেই দামোদরের বাম দিকের বাঁধের (Left -Embankment)সালালপুর শ্মশান-ঘাট থেকে সারাংপুর পর্যন্ত অংশে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গেছে ।ক্ষতি আর যাতে না বাড়ে তার জন্যে বাঁধের উপর দিয়ে বালি বোঝাই ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করতেই হবে।তা না হলে,প্লাবন মরশুমে বাঁধ বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে খুবই খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হবে ।
কিন্তু দামোদরের বাম দিকের বাঁধের(Left Embankment) ক্ষতি নিয়ে কেন সেচ দফতর এত চিন্তিত?কেনই বা এই বাঁধ এত গুরুত্বপূর্ণ?এর উত্তরে অশোক দাস বলেন,’প্লাবন মরশুমে ভয়াল রুপ ধারণ করে দামোদর।তখন যদি দামোদরের এই বাঁধে বিপর্যয় ঘটে যায় তাহল হাওড়া-বর্ধমান কর্ড ও মেইন এবং বিডিআর রেলপথ ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি কলকাতার দোরগোড়া পর্যন্ত প্লাবনের কবলে পড়েযাবে।তেমনটা হলে রাজ্যের শস্যগোলার কৃষি ক্ষেত্র সহ জীবন ও সম্পত্তিরও প্রভূত ক্ষতি হয়ে যাবে ।’ অশোকবাবু বলেন,’এসব ভেবেই সেচ দফতরের মত আতঙ্কিত জামালপুরের দাদপুর সারাংপুর ও হাবাসপুর গ্রামের বাসিন্দারা।তাই হুমকি শাসানি সত্ত্বেও গ্রামবাসীরাই এখন বাঁধের উপর দিয়ে বালি বোঝাই ভারী যানবাহন চলাচল নিয়ে প্রতিবাদে সরব হচ্ছেন ।
দামোদর তীরবর্তী গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, দামোদরের বাঁধের উপর দিয়ে বালি বোঝাই যানবাহন যাতায়াতই শুধু নয়।দামোদর নদ থেকে বালি তোলার ক্ষেত্রেও কোন নিয়ম নীতি মানা হয় না। গ্রামবাসীদের আনা এই অভিযোগও সত্য বলে জানিয়েছেন অশোক দাস।এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন,’সরকারী নিয়মে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে নদী বাঁধের কিনারার ৬৬০ ফুট দূরথেকে বালি তুলতে হবে।কিন্তু বালি কারবারীরা সেই নিয়ম নীতির কিছুই মানে না।ভূমি দফতরের নজরদারি না থাকায় বালি কারবারীরা বাঁধের একেবারে গা ঘেঁষেই বালি কেটে নেয়। এমনকি বাঁধের কাছে থাকা বালির চর কেটে বালি তুলেনিতেও বালি কারবারীরা দ্বিধা বোধ করে না।এমন কি ’’গ্রীণ ট্রাইব্যুনালের’ রায় অগ্রাহ্য করে কোথাও দামোদর নদের বুকে ভারী যানবাহন নামিয়ে আবার কোথাও ’ড্রোজিং মেশিন’ দিয়ে বালি তুলে নেওয়া চলছে।শুধু তাই নয়,সূর্যাস্তের পর নদ-ন্দী থেকে বালি তোলার ব্যাপারে গ্রীণ ট্রাইব্যুনালের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হয় না।এখনতো আবার গ্রীণ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ অমান্য করেই দামোদরের গতীপথ অবরুদ্ধ করে সেতু তৈরি করাহচ্ছে।বালি বোঝাই লরি ও ডাম্পার যাতে চলবলপুর সংলগ্ন এলাকা থেকে খুব সহজে সারাংপুর হয়ে রাজ্য সড়কে পৌছে পারে তাই ওই ’সেতু’ বালি কারবারীরা তৈরি করা হচ্ছে বালে স্থানীয়রা জেনেছেন। অশোক বাবুর দাবি,“বালি কারবারীদের এইসব কাজকারও পরোক্ষভাবে দামোদরের বাঁধের ক্ষতি করেছে ।”
জেলাশাসক বিধান চন্দ্র রায় জানিয়েছেন, দামোদরের গুরুত্বপূর্ণ বাঁধের উপর দিয়ে বালির গাড়ি যাতায়াত করতেই পারে না। যদি এটা তবে তা রোখার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে“। আর সেচ দফতরের একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার (দামোদর ক্যানেল ডিভিশন ১) প্রণব কুমার সামন্ত বলেন,’দামোদরের বাঁধ(Left Embankment) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি আমরাও জেনেছি।আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রেখেছি। বাঁধের ক্ষতির বিষয়টি সন্মন্ধে ইদিলপুর ১ সাবডিভিশনাল অফিস তরফে ইতিমধ্যেই জেলা ও ব্লক প্রশাসনের নানা মহলে চিঠি লিখে জানানো হয়েছে। তাতে বাঁধের উপর দিয়ে বালি বোঝাই যানবাহন চলাচল বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের কথাই বলা হয়েছে।’।