এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,২৭ জুলাই : আজ বিজেপির যুবনেতা ও কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী তরুনজ্যোতি তিওয়ারি এক্স-এ সিপিএম নেত্রী দিপ্সিতা ধরের ছবি ও বাংলাদেশের ইসলামি নেতা চীনপন্থী মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কিছু মন্তব্যে লেখা পোস্টার পোস্ট করেছেন । দিপ্সিতা ধরের হাতে রয়েছে বামপন্থী লেখিক সৌমিত্র দস্তিদার (Soumitra Dastidar) এর লেখা “আমি ও আমার মাওলানা ভাসানী” বই । বইটির মলাটে রয়েছে ভাসানীর ছবির স্কেচ । পোস্টারে ভাসানীর দুটি বক্তব্য লেখা আছে । একটি লেখা আছে “ভারত আমাদের জাত শত্রু এই কথাটা যে প্রজন্ম বুঝতে পারবে, তারাই এই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান” । অপর একটি পোস্টারে লেখা হয়েছে,”আসাম আমার । পশ্চিমবঙ্গ আমার । ত্রিপুরাও আমার । এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না” ।
তরুণজ্যোতি প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘এটাই বামপন্থীদের আসল চেহারা। বামপন্থী নেত্রী Dipsita বুকে একটা বই ধরে আছে এবং তার ওপর একটা ছবি আছে নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন আপনারা। কার ছবি জানেন ? তার অমর উক্তি গুলো জানেন ? চরম ভারত বিরোধী এই মাওলানা ভাসানী কে নিয়ে বামপন্থীদের আগ্রহ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।’ তিনি লিখেছেন, বামেদের চরিত্র: বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে,ঘটনা দেখে শিউরে উঠেছি। মিছিলে হেঁটেছি, দেখতে পেয়েছি গাজার অশ্রুবিন্দু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া মন্দিরের পাশে লাশ হয়ে থাকা মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং বাংলাদেশের হিন্দু।’ সবশেষে তরুনজ্যোতি লেখেন,ছবি কথা বলে। এখানে ছবি বামপন্থীদের চরিত্র সামনে রাখছে।’
https://twitter.com/tjt4002/status/1949353129054445833?t=cICXnQU975Ay54nx73qmsQ&s=19
বামপন্থীদের ‘ভন্ডামি’ নিয়ে ত্রিপুরার প্রাক্তন রাজ্যপাল ও হিন্দুত্বপন্থী লেখক তথাগত রায়ও তীব্র সমালোচনা করেছেন । তার কথায়,’কেউ ভাবতে পারেন এটা বামপন্থীদের স্বাভাবিক পশ্চাৎপক্কতা। কিন্তু শুধু তা নয়। এটা ভিন্ডি বাজার-মাহীমের মুসলমান ভোট ধরার প্রাণপণ চেষ্টা। গাজ়ায় ইজ়রায়েলের হামলার প্রতিবাদে মুম্বইয়ের আজাদ ময়দানে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করতে চেয়েছিল এআইপিএসএফ (অল ইন্ডিয়া পিস অ্যান্ড সলিডারিটি ফাউন্ডেশন)। কিন্তু অনুমোদন দেয়নি মুম্বই পুলিশ। এর পরেই মুম্বই পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে যায় সিপিআইএম।
মামলার শুনানিতে বিচারপতি রবিশঙ্কর ঘুঘে এবং বিচারপতি গৌতম আঙ্কাদের ডিভিশন বেঞ্চ বলে, ‘আপনারা গাজ়া আর প্যালেস্টাইন নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু নিজের দেশের দিকে তাকান। দেশপ্রেমী হোন। এটা দেশপ্রেম নয়।’ একইসঙ্গে সিপিএমকে দেশের ইস্যু নিয়ে সরব হওয়ার পরামর্শও দিয়েছে আদালত।’
একজন তথাগতর এক্স-এর ওই পোস্টে মন্তব্য করেছেন, ‘বামপন্থীদের মধ্যে দেশপ্রেমী খোঁজা আর অন্ধকারে নিজের ছায়া খোঁজা একই ব্যপার !’ তার এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তথাগত রায় লিখেছেন,’বাঙালি-হিন্দু নাকি ‘স্বভাবতই বামপন্থী’, এটা পরীক্ষা করার জন্য ছোট্ট একটা এক্সপেরিমেন্ট। যে কোনো দুটো দেওয়াল বেছে নিন। তারপর একটাতে আমাদের ঠাকুর-দেবতার ছবি, আর অন্যটাতে মার্কস-লেনিনের ছবি লাগান। তার পর দেখুন বাঙালি-হিন্দু মূত্রত্যাগের জন্য কোনটা পছন্দ করে!’
কে ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ?
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ ধানগড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন । তার বাবার নাম শরাফত আলী । পীর সৈয়দ নাসির উদ্দিন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে বোগদাদীর কাছে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন ভাসানী। সেখান থেকে তার ইসলামি ধর্মীয় জীবনে পাঠ্য শুরু হয় । আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর বাল্য নাম ছিল চেগা মিয়া । মওলানা ভাসানী ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পাকিস্তান শাসনকালেও ভাসানীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশ জনপ্রিয় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবর রহমানের উত্থান হলে তিনি তার সঙ্গীদের নিয়ে ভারতে পালিয়ে আসে।
মওলানা ভাসানীকে নিয়ে গবেষণা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী লেখক ও গবেষক সৌমিত্র দস্তিদার। ‘আমি ও আমার মওলানা ভাসানী’ শিরোনামে তার একটি বইও রয়েছে। দস্তিদার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “মওলানা ভাসানী যখন আসাম সীমান্তে আসলেন তখন তাকে অভ্যর্থনা করা হয়েছিল ভালো মতোই। তখন আসামের মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী মওলানা ভাসানীর শিষ্যের মতোই ছিলেন।”
তবে, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মওলানা ভাসানী ভারত যেতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন লন্ডন যেতে। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা তাকে কলকাতায় লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করেছিল বলে অভিযোগ। ইউকিপিডিয়া অনুযায়ী, মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মানুষের কাছে “মজলুম জননেতা” হিসাবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি চীনের মাওপন্থী কম্যুনিস্ট তথা বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তাছাড়াও উপমহাদেশে কম্যুনিস্ট ধারার রাজনীতির প্রসারে তার বিশেষ অবদান ছিল। এজন্য তার অনুসারীরা তাকে “লাল মওলানা” নামেও ডাকতেন। তিনি কৃষকদের জন্য পূর্ব পাকিস্তান কৃষক পার্টি করার জন্য সারাদেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
বিবিসি বাংলা একটা প্রতিবেদনে বলেছিল যে শাহ আহমদ রেজা ১৯৭১ সালে প্রকাশিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাকে উদ্ধৃত করে ‘যুগে যুগে মওলানা ভাসানীর সংগ্রাম’ বইতে লিখেছেন, “পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় মার্কসবাদী কমিউনিস্ট নেতা হরে কৃষ্ণ কোঙার ১৪ই মে অভিযোগ করেছিলেন যে, ‘মওলানা ভাসানীকে কলকাতাতেই কোথাও অন্তরীণ রাখা হয়েছে’।” জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, মওলানা ভাসানী কোথায় আছে সেটা তিনি বা তার সরকার জানেন না।” মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’ – এর ২১শে মে ১৯৭১ সংখ্যার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ভাসানী কলকাতাতেই অন্তরীণ, কিন্তু সরকার নীরব!’
সেসময়কার বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মওলানা ভাসানী ভারতের কোন একটি জায়গায় ছিলেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন। কখনো থেকেছেন কলকাতায়, কখনো আসামে, কখনো বা দেরাদুনে।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ‘ভারত বিরোধী নেতা’
বিবিসি বাংলা লিখেছে,পাকিস্তানের রাজনীতিতে মওলানা ভাসানী অনেকের কাছে ‘ভারত বিরোধী’ নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যে কারণে তিনি ভারত সরকারের পছন্দের তালিকায় ছিলেন না। তবে রাজনীতিবিদ হিসেবে ভাসানীকে উপেক্ষা করার সুযোগও ছিল না। কলকাতার বামপন্থী লেখক ও গবেষক সৌমিত্র দস্তিদারও ভাসানীর হয়ে সওয়াল করে বিবিসিকে বলেছিলেন, “মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তৎকালীন ভারত সরকারের মধ্যে অস্বস্তি ছিল। এর বড় কারণ হচ্ছে, তার চীনপন্থী রাজনীতি। ভারত যেহেতু চীনের প্রতিপক্ষ সেজন্য মওলানা ভাসানীকে আস্থায় নিতো না ভারত সরকার। তবে ভারতের অনেক রাজনীতিবিদদের মধ্যে মওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা ছিল।” বিবিসি বাংলাকে সৌমিত্র দস্তিদার বলেন, “ওনার গায়ে চীনপন্থী হিসেবে ছাপ ছিল। উনি সেটা অস্বীকারও করতেন না। তখন তো পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন ভয়ঙ্কর চেহারায় ছিল। তারাও ছিল চীনপন্থী। যদি মওলানাও কখনো নকশালদের সমর্থন করেন সে চিন্তাও ছিল ভারত সরকারের মনে। এসব নিয়ে গোয়েন্দা রিপোর্ট মওলানার বিপক্ষে ছিল। সে আশংকা থেকে ভারত সরকার মওলানাকে নিয়ে ঝুঁকি নিতে চায়নি।”
ভাসানীর ভারত বিরোধী মনোভাব থাকায় ভারতের ইন্দিরা গান্ধী সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে নজরবন্দি করে রেখেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব যাতে বামপন্থীদের হাতে চলে না যায় সেজন্য বেশ চিন্তিত ছিল ভারত সরকার। সেজন্য তারা মওলানা ভাসানীকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল বলেও বিভিন্ন লেখায় উঠে আসে।সৌমিত্র দস্তিদার মনে করেন,”ভারতে থেকে মওলানা ভাসানী যদি কথা বলেন তাহলে অন্য নেতাদের কথাগুলো গৌণ হয়ে যাবে। গণমাধ্যমে এবং রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো ভাসানীকেই গুরুত্ব দেবে। এসব কারণেও ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি ।” যদিও বাংলাদেশ পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে ভাসানী সেখানে পালিয়ে যান এবং সেখানেই মৃত্যু হয় তার ।।