প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৪ অক্টোবর : পঞ্জিকার সময় সারণী মেনে শেষ হল পিতৃপক্ষ।আজ থেকে শুরু হল দেবী পক্ষ।পিতৃপক্ষে শেষ আর দেবী পক্ষের সূচনা লগ্নই হল ’মহালয়া’ ।ওই দিন ভোর থেকেই আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হওয়া শুরু হয়েযায় দেবীর আগমন বার্তা । যে আগমন বার্তা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে রেডিওয় প্রসার ভারতী সম্প্রচারিত মহালয়া শীর্ষক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে ।পবিত্র এই দিনে আপামোর বাঙালি তাঁদের পিতৃপুরুষের আত্মার তৃপ্তি কামনায় সারেন তর্পন ।
দেবীপক্ষের বিশেষ এই দিনটির ভোরে প্রতিটি বাঙালির ঘরেঘরে সবথেকে বেশী কদর থাকে রেডিওর । দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের রমরমার যুগে শুধুমাত্র এই একটি দিন ’শ্রবন যন্ত্র’ রেডিওর টিআরপি থাকে তুঙ্গে । কারণ দেবী পক্ষে মহিষাশুর মর্দীনির মুর্চ্ছনায় মহালয়া শীর্ষক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান শুধুমাত্র রেডিওতেই সম্প্রচারিত হয় । যে অনুষ্ঠান আজও একমেবদ্বিতীয়ম ।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অনবদ্য মহিমাকে সম্বল করেই আজও বাঙালির কাছে নস্টালজিক হয়ে আছে রেডিওয় আকাশবাণী সম্প্রচারিত মহালয়ার এই বিশেষ অনুষ্ঠান । মহালয়ার অনুষ্ঠান রেডিওয় প্রথম সম্প্রচারিত হয় ১৯৩১ সালে । বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর চণ্ডীপাঠ আর পঙ্কজ কুমার মল্লিক , দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় , সুপ্রীতি ঘোষ সহ অন্যান খ্যাতনামা শিল্পীদের কণ্ঠে ধ্বনিত আগমনী সঙ্গীত বাঙালিকে আজও আবেগ প্রবণ করেতোলে । সেই আবেগ আজও ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত রয়েছে ।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাতধরে রেডিওর বিকল্প অনেক কিছু আবিস্কার হয়েছে ঠিকই।তা সত্বেও দেবীপক্ষের এই বিশেষ দিনটিতে আটথেকে আশি সকল বাঙালি রেডিওয় মহালয়ার মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান শুনে পির্তৃ পুরুষের উদ্দশ্যে তর্পণ সারতে পবিত্র জলাশয়ের ঘাটের দিকে রওনা হন ।
রেডিও আবিস্কারের ইতিহাস বহু পুরানো । ১৮৯৮ সালে আবিস্কৃত হয়েছিল রেডিও । ইতালীয় বিজ্ঞানী গুইলিইমো ( guglielmo) মার্কনি রেডিও আবিস্কার করেছিলেন ।এই মার্কনী প্রথম রেডিওয় বাণিজ্যিক সার্ভিস চালু করেন।তার পর থেকে একটা যুগ গেছে যখন প্রতিটি গৃহস্থ পরিবারে রেডিওর অসামান্য কদর ছিল । রেডিওয় প্রভাতি গানের সুর ঘুম ভাঙাতো অনেককেই । গল্প দাদুর আসর কিংবা ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান দলের ফুটবল ম্যাচ, সবেরই সম্প্রচার শোনার জন্য তখন রেডিওই ছিল একমাত্র মাধ্যম ।পরবর্তী কালে দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের রমরমায় রেডিওর গুরুত্ব ও কদর আস্তে আস্তে ফিকে হয়েযায়।বর্তমান প্রজন্মতো আবার রেডিও নামটাই ভুলেযেতে বসেছে।তবে এতকিছুর পরেও মহালয়ার দিনের ভোরে তামাম বাঙালি আঁকড়ে ধরে সেই রেডিওকেই।বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সৌজন্যে মহালয়ার দিনটায় বাঙালির ঘরে ঘরে জানান দেয় মার্কনীর আবিস্কৃত সেই রেডিওর উপস্থিতি ।
ছোট বাক্স আকারের একটি যন্ত্র । যাতে রয়েছে এপাস ওপাস ঘুরিয়ে অন ও অফ করা যায় এমন দু-তিনটি সুইচ । সুইচ অন করলেই শুরু হয় ইথার তরঙ্গে ভেসে আসা সোঁসোঁ শব্দ । মহালয়ার দিন ভোরে রেডিওতে থাকা এমনই একটি সুইচ একটু একটু করে ঘুরিয়ে আকাশবাণী কলকাতা “ক” সেন্টারে যুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েযায় ব্যতিক্রমী সেই অনুষ্ঠান । “ জাগো দুর্গ , জাগো দশপ্রহরণ ধারিণী , অভয়া শক্তি বলপ্রয়ো ধারিনী তুমি জাগো ”। রেডিওয় ভেসে আাসা সেই হৃদয়স্পর্শি দেবী বন্দনা শুনে নস্টালজিক হয়েপড়েন আপামোর বাঙালি হিন্দুরা । তাই এই শুর ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালির ঘরে ঘরে শুরু হয়েযায় শঙ্খ ধ্বনী । দেবীকে আহ্বানের সূচনায় রেডিওয় সম্প্রচারিত মহালয়ার এই মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান আজও নিজস্ব স্বকীয়তায় কিংবদন্তী হয়ে রয়েছে ।
আকাশবাণী সম্প্রচারিত মহালয়ার অনুষ্ঠান চির অমর করে রাখার নেপথ্য কারিগর হিসাবে গণ্য হয়ে আসছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র । কবিতা পাঠ ও সংস্কৃত চর্চার প্রতি বরাবরই আলাদা টান ছিল হৃদয়স্পর্শি কন্ঠশ্বরের অধিকারী এই ব্যক্তির। ১৯২৮ সালে স্কটিশ চার্য কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর তিনি ’ফেয়ারলিপ্লেসে’ রেল দফতরের অফিসে চাকরিতে যোগ দেন । কিন্তু চাকরিতে তার মন বসছিল না ।সেই বছরই চাকরি ছেড়েদিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চলে এলেন বেতারে ।এখানে নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে আসা বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছে একদিন এল মহালয়ার মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান করার সেই সন্ধিক্ষণ । সেদিন সরাসরি সম্প্রচারিত মহালয়ার অনুষ্ঠান শুরুতেই আবেগ ঘন কণ্ঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বলা শুরু করলেন “আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির,ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগৎ মাতার আগমন বার্তা” ।
শোনা যায় সেদিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের আবেগ ঘণ কণ্ঠে ধ্বনিত এই শব্দমালা শুনে কার্যত “থ” বনে গিয়েছিলেন আকাশবাণীতে উপস্থিত অন্য শিল্পীরা । শুধু ইশারায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে অভয় যুগিয়ে গিয়েছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক । আকাশবানী সম্প্রচারিত সেদিনের অনুষ্ঠান শেষ হবার সাথে সাথেই আপামোর বাঙালির হৃদয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন । কালজয়ী এই শিল্পী ইহলোক ত্যাগ করেছেন ঠিকই। তবে আজও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে কেউ ভুলতে পারেন নি । ভুলতে চানও না । তাই তাকে হৃদয় মাঝারে রেখেই মহালয়া এই বাংলায় সমাদৃত হয়ে আসছে ।।