জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,গুসকরা(পূর্ব বর্ধমান),২৮ মে : সিন্ধু সভ্যতা বা মিশরীয় সভ্যতা – যেটাই হোকনা কেন পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীর তীরে। মৎস্য চাষ, সেচ বা পরিবহন প্রভৃতি নানা ধরনের উপকারের জন্য নদীকে বলা হয় ‘লাইফ লাইন’। কোনো কোনো নদীর জল শোধন করে পানীয় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আবার নদীকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠতে পারে।
তবে ‘এ নদী এমন নদী/ জল চাই একটু যদি’ গ্রীষ্মকালে একটুও জল না পাওয়া গেলেও বর্ষার সময় দু’কূল ভাসিয়ে চোখের জলে ভাসিয়ে দেয় পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট ও আউসগ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের চাষীদের। চোখের জল ঝরে পড়ে নদীর কাছাকাছি বাস করা গরীব মানুষের। বন্যার জল তাদের সাধের কুঁড়েঘর ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। শুধু তাই নয় এই সময় আতঙ্কে থাকে গুসকরা পুরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। তখন গুসকরা হয়ে ওঠে দ্বীপ শহরের মত – চারপাশে জল, মধ্যেখানে স্থল।
নামে নদী হলেও একে ঠিক নদী বলা যায় না। এর থেকে ডিভিসির প্রধান সেচখাল অনেক বেশি চওড়া। তবুও নদী হিসাবে একটা ইজ্জত আছে! যতই হোক এটা হলো অজয় নদের অন্যতম প্রধান উপনদী। এই নদীর উৎপত্তিস্থল হলো পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসা থানার অন্তর্গত ঝাঁঝরার বিখ্যাত ডাঙ্গাল কালীমন্দির এলাকায়। দেখলে মনে হবে ছোট্ট একটি ডোবা থেকে কুনুরের উৎপত্তি। কুনুরের উৎসস্থলকে বড় চৌবাচ্চার মত পাঁচিল দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। একে নিয়ে সাধক কবি নীলকণ্ঠ মুখার্জ্জী গানও বেঁধেছিলেন। তিনি একে ভগবতী গঙ্গা বলে উল্লেখ করেছেন।
যাইহোক উৎস থেকে প্রায় ১১২ কিমি দীর্ঘ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আউশগ্রাম ও মঙ্গলকোট ব্লকের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোগ্রামের উজানি গ্রামের কাছে অজয় নদে গিয়ে মিশেছে কুনুর ৷ যাবার পথে গুসকরা শহরকে কার্যত দু’টি ভাগে ভাগ করে দিয়ে গেছে। বর্ষার সময় উৎসমুখ ও উপত্যকা অঞ্চলের বৃষ্টির জল হলো এই নদীর জলের একমাত্র উৎস। তবে বর্ষার সময় এই নদী ভয়ংকর রূপ ধারণ করলেও অন্য সময় একে দেখে মনে হবে দীর্ঘদিন ধরে খেতে না পাওয়া রাস্তার ধারে অবহেলায় পড়ে থাকা অসহায় শীর্ণকায় এক মানুষ। সেই সময় স্রোতহীন নদীর বুকে জমা হয় কচুরিপানা। নদীর এই অবস্থা দেখেই হয়তো কবি লিখেছিলেন – ‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে / সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে ।’ এই দৃশ্য কুনুর নদীর বুকে বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়।

কৃষি প্রধান এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত এই নদী যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংস্কার করা হয় তাহলে এলাকার চাষীরা যেমন উপকৃত হবে তেমনি গুসকরা শহরের বাসিন্দারা জলা জমের আতঙ্ক থেকে বাঁচবে। এমনকি এরফলে শহরের নিকাশী ব্যবস্থা উন্নত হবে।
অগভীর নদী গর্ভ থেকে মাটি তোলা হলে নদীর জল ধারণ ক্ষমতা বেড়ে যাবে। ফলে বন্যার প্রকোপ কিছুটা হলেও কমবে। সঙ্গে সঙ্গে গুসকরা শহরের জলা জম দ্রুত নেমে যাবে। এছাড়া নদীর বুকে যদি কয়েকটি লক গেট তৈরি করা হয় তাহলে বর্ষার জল ধরে রেখে গ্রীষ্মের সময় কৃষিকার্যের জন্য সেই জল ব্যবহার করা যাবে। উপকৃত হবে স্থানীয় কৃষকরা। সেক্ষেত্রে নদীর বুক থেকে জল তুলে সারাবছর তারা ফসল উৎপাদন করতে পারবে।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে অবিভক্ত বর্ধমান জেলা পরিষদের বরাদ্দ করা অর্থে কুনুর নদীর সংস্কারের কাজ হয়েছিল। কাজ হয়েছিল সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। ছিলনা কোনো মাস্টার প্লান। ফলে নদীর নাব্যতা নুন্যতম বাড়েনি, উল্টে নদীর পাড়ে জড়ো করে রাখা মাটি বর্ষার জলে গলে গিয়ে আবার নদীর গর্ভেই ফিরে আসে। ফলে কাজের কাজ কিছু হয়নি, নদী ফিরেছিল আগের দশায়। মাঝখান থেকে অযথা অর্থব্যয় হয়। স্থানীয়রা ঠাট্টা করে বলত – এতো নদী সংস্কার নয়, দাড়ি কাটার মত নদীর গাল চাঁছা হয়েছে। কেউ কেউ বলত নদী সংস্কারের নামে স্থানীয় কোনো প্রভাবশালী নেতার ছেলেকে কিছু অর্থ পাইয়ে দেওয়ার জন্য এই নাটক করা হয়েছিল।
সঠিক পরিকল্পনা ও আধুনিক ড্রেজিং যন্ত্রের সাহায্যে যদি কুনুর নদীর সংস্কার করা হয় তাহলে নিশ্চিত রূপে নদী সংলগ্ন আউশগ্রাম ও মঙ্গলকোটের চাষীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে। বদল ঘটবে এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির। সঙ্গে সঙ্গে উপকৃত হবে গুসকরা শহরের। বর্ষার সময় জমা জল দ্রুত বের হয়ে গেলে জল যন্ত্রণা থেকে বাঁচবে শহরের একাধিক ওয়ার্ড।
কথা হচ্ছিল মঙ্গলকোটের বালিডাঙার চাষী তাপস বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বললেন,’আমাদের এলাকাটা নীচু। বর্ষার সময় দীর্ঘদিন ধরে জমিতে নদীর জল জমে থাকার জন্য আমরা এই সময় কার্যত ফসল পাইনা। নদী সংস্কার করা হলে সত্যিই আমরা উপকৃত হব। একইসঙ্গে নদীর বুকে কয়েকটি লক গেট করে যদি জল ধরে রাখা হয় তাহলে শীতের মরশুমে আমরা ফসল উৎপাদন করতে পারব।’
কুনুর নদী নিয়ে কথা হচ্ছিল আউশগ্রামের বিধায়ক অভেদানন্দ থাণ্ডারের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা ওয়াকিবহাল আছি। ইতিমধ্যে আমরা সেচ দপ্তরের সঙ্গে নদী সংস্কারের বিষয়ে কথা বলেছি। আশা করি ভাল কিছু হবে ।’একই কথা বললেন মঙ্গলকোটের বিধায়ক অপূর্ব চৌধুরী।
অন্যদিকে গুসকরা পুরসভার চেয়ারম্যান কুশল মুখার্জ্জী বললেন,’নদী সংস্কারের বিষয়টি পুরোপুরি সেচ দপ্তরের হাতে। আমরা গুসকরাবাসীর স্বার্থে ইতিমধ্যে সমস্যা সম্পর্কে আমাদের বিধায়ককে অবহিত করেছি। তিনিও সমস্যা নিয়ে চিন্তিত। নদীটির সংস্কার করা হলে জমা জলের হাত থেকে শহরবাসী নিশ্চিতরূপে রক্ষা পাবে ।’।

