এইদিন ওয়েবডেস্ক,১৬ এপ্রিল : ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন বিষ্ণুর অষ্টম অবতার । শ্রীমদভগবদগীতার প্রবর্তক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সনাতন তথা বৈষ্ণব ধর্মে পরব্রহ্ম উপাধিতে ভূষিত করা হয় । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিতামাতা হলেন বসুদেব ও দেবকী । পালক পিতা নন্দ ও পালক মাতা যশোদা । দাদা বলরাম,বোন সুভদ্রা এবং পালক বোন যোগমায়া । শূরসেন রাজ্যের (বর্তমান উত্তর প্রদেশ) মথুরায় ৩২২৮ খ্রিস্টপূর্বে ১৮ অথবা ২১ জুলাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে মনে করা হয় । বলা হয় যে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ৩১০২ খ্রিস্টপূর্ব ১৮ ফেব্রুয়ারী গুজরাটের বর্তমান ভেরাভাল(প্রাচীন সৌরাষ্ট্র রাজ্যের ভালকায় ৷ সেই হিসাবে তাঁর আয়ূ ছিল ১২৬ বছর ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রীর সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন দাবি করা হয়েছে । পুরাণ অনুযায়ী শ্রী কৃষ্ণের পত্নী আসলে আটজন এবং তাঁদের মধ্যে প্রধান হলেন রুক্মিণী। তবে এই বিষয়েও নানা মত প্রচলিত আছে। বিভিন্ন পুরাণ অনুযায়ী কৃষ্ণের পত্নীর সংখ্যা কখনও ৭, কখনও ৮ আবার কখনও ৯ বলা হয়েছে । হরিবংশ পুরাণে এই সংখ্যাটি বলা হয়েছে ৭ । আর তাঁরা হলেন, রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, মিত্রবিন্দা, নগ্নজিতী, মাদ্রী ও লক্ষণা। মহাভারত অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের পত্নী সংখ্যা ৮ । তাঁরা হলেন, রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, মিত্রবিন্দা, নগ্নজিতী, মাদ্রী, লক্ষণা ও রোহিনী। ‘বিষ্ণুপুরাণ’ অনুসারে কৃষ্ণের ৯ জন স্ত্রী ছিলেন- রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা, নগ্নজিতী, মাদ্রী, লক্ষণা ও রোহিনী। তবে ‘ভগবৎ পুরাণ’ অনুযায়ী কৃষ্ণের আটজন পত্নীর কথা বলা হয়েছে ।
ভগবান কৃষ্ণের ৮ প্রধান রাণী ছিলেন যা ‘অষ্টভার্যা’ নামে পরিচিত – রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, কালিন্দী, মিত্রবিন্দ, নাগনাজিতি, লক্ষ্মণ এবং ভদ্র ।
তাঁদের অনেক পুত্র ও কন্যা ছিল ।প্রতিটি স্ত্রী থেকে তার ১০ টি করে মোট ৮০ টি সন্তান ছিল। কৃষ্ণের পুত্র এবং কন্যারাও অসাধারণ ক্ষমতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির অধিকারী বলে পরিচিত । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ৮ স্ত্রী ও সন্তানদের সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা হল :-
১)রুক্মিণী: বিদর্ভ রাজ্যের ভীষ্ম নামে এক সাহসী রাজা ছিলেন। তার মেয়ের নাম ছিল রুক্মিণী। তিনি ছিলেন লক্ষ্মীজীর অবতার। তিনি অত্যন্ত সুন্দরী এবং সমস্ত গুণাবলী ছিল. নারদজির শ্রীকৃষ্ণের গুণাবলীর বর্ণনা শুনে রুক্মিণী শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। রুক্মিণীর সৌন্দর্য ও গুণের আলোচনা শুনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণও রুক্মিণীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। রুক্মিণীর ভাই রুক্মী শিশুপালের সাথে রুক্মিণীর বিয়ে ঠিক করেছিলেন। বিয়ের একদিন আগে শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীকে দ্বারকায় নিয়ে যান। দ্বারকায় পৌঁছে শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণীর বিয়ে হয়। রুক্মিণীর দশটি পুত্রের জন্ম হয়। রুক্মিণীর পুত্রদের নাম; প্রদ্যুম্ন, চারুদেষ্ণা, সুদেষ্ণা, চারুদেহ, সুচারু, বিচারু, চারু, চারুগুপ্ত, ভদ্রচারু, চারুচন্দ্র।
২)জাম্ববতী : সত্রাজিৎ নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ভগবান সূর্যের পূজা করেছিলেন। এতে খুশি হয়ে ভগবান তাকে রত্ন দান করলেন। একদিন সত্রাজিতের ভাই প্রসেন মণি নিয়ে বনে শিকার করতে গেল। সেখানে একটি সিংহ প্রসেনকে হত্যা করে রত্নটি ছিনিয়ে নিয়ে তার গুহায় লুকিয়ে থাকে। কিছু দিন পর ঋক্ষরাজ জাম্ববন্ত সিংহটিকে মেরে রত্নটি নিজের কাছে রাখেন। সত্রাজিৎ রত্ন চুরি এবং তার ভাইকে হত্যার জন্য শ্রী কৃষ্ণকে দোষারোপ করেন। এই দোষ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণ সেই রত্নটির সন্ধানে বনে যান। মণির আলো নিয়ে শ্রী কৃষ্ণ সেই গুহায় পৌঁছে গেলেন যেখানে জাম্ববন ও তাঁর কন্যা জাম্ববতী থাকতেন। শ্রীকৃষ্ণ ও জাম্ববন্তের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়।
যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর জাম্ববন জানতে পারলেন যে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বিষ্ণুর অবতার। শ্রী কৃষ্ণের আসল রূপ জানতে পেরে, জাম্ববন তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং তাঁর অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে, তিনি তাঁর কন্যা জাম্ববতীকে শ্রী কৃষ্ণের সাথে বিবাহ করেছিলেন। জাম্ববন্তীর সন্তানরা হলেন : সাম্বা, সুমিত্রা, পুরুজিৎ, শতজিৎ, সহস্রাজিৎ, বিজয়, চিত্রকেতু, বসুমান, দ্রাবিড় ও ক্রতু।
৩) সত্যভামা: শ্রীকৃষ্ণ মণি নিয়ে দ্বারকায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে পৌঁছে শ্রীকৃষ্ণ সেই রত্ন সত্রাজিতকে দিয়েছিলেন এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হলে সত্রাজিৎ লজ্জিত বোধ করতে শুরু করেন। তিনি শ্রী কৃষ্ণের মহিমা জানতেন, সত্রাজিৎ তাঁর কন্যা সত্যভামাকে শ্রীকৃষ্ণের সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। সত্যভামার সন্তনদের নাম ছিল : ভানু, সুভানু, স্বরভানু, প্রভানু, ভানুমান, চন্দ্রভানু, বৃহদ্ভানু, অতিভানু, শ্রীভানু ও প্রতিভানু।
৪) সত্য (নাগনাজিত): কৌশল রাজ্যের রাজা নাগনাজিতের কন্যা ছিলেন। যার নাম ছিল নাগাজিতি। নাগাজিৎ তার মেয়ের জন্য উপযুক্ত বর পেতে শর্ত দেন। শর্ত ছিল যে ক্ষত্রিয় যোদ্ধা সাতটি ষাঁড়কে জয় করতে পারবে তাঁর সঙ্গে নাগনাজিতীর বিয়ে হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন নাগজিতি শ্রীকৃষ্ণকে বিয়ে করতে চান। তাঁর ভক্তের ইচ্ছা পূরণের জন্য, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সাতটি ষাঁড়কে তাঁর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন এবং তাদের জয় করেন। ভগবানের এই সাহসিকতা দেখে নাগজিৎ তাঁর কন্যাকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে বিয়ে দেন। সত্যের সন্তানরা হলেন : বীর, অশ্বসেন, চন্দ্র, চিত্রগু, বৈগবান, বৃষ, আম, শঙ্কু, বাসু ও কুন্ত।
৫) কালিন্দী: একবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার প্রিয় অর্জুনকে নিয়ে বনে বিচরণ করছিলেন। যাত্রার চাপ দূর করার জন্য দুজনেই গিয়ে যমুনা নদীর তীরে বসলেন। সেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন একটি মেয়েকে তপস্যা করতে দেখেন। মেয়েটিকে দেখে অর্জুন তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি তার নাম সূর্যপুত্রী কালিন্দী বলে। যমুনা নদীতে অবস্থানকালে তিনি ভগবান বিষ্ণুকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য তপস্যা করছিলেন। এটা জেনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কালিন্দীকে বললেন যে তিনি ভগবান বিষ্ণুর অবতার এবং তাকে নিয়ে দ্বারকায় চলে যান। দ্বারকায় পৌঁছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও কালিন্দীর বিয়ে হয়। কালিন্দীর সন্তানদের নাম : শ্রুত, কবি, বৃষ, বীর, সুবাহু, ভাদ্র, শান্তি, দর্শ, পূর্ণমাস ও সোমক।
৬) লক্ষ্মণ: লক্ষ্মণ দেবর্ষি নারদের কাছ থেকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছিলেন। তাঁর মন সর্বদা ভগবানের স্মরণ ও ভক্তিতে মগ্ন থাকত। লক্ষ্মণ ভগবান বিষ্ণুকে স্বামী হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন। তার বাবা এটা জানতেন। মেয়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য, তার বাবা একটি স্বয়ম্বর সংগঠিত করেছিলেন যাতে ভগবান বিষ্ণুর অবতার ভগবান কৃষ্ণ ছাড়া আর কেউ লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। লক্ষ্মণের বাবা তার মেয়েকে সেই সাহসী ব্যক্তির সাথে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে জলে মাছের প্রতিফলন দেখে লক্ষ্যভেদ করতে পারে। শিশুপাল, কর্ণ, দুর্যোধন, অর্জুন থেকে কেউই এই লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। অতঃপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শুধু ছায়া দেখে মাছকে লক্ষ্য করে স্বয়ম্বরে বিজয়ী হন এবং লক্ষ্মণকে বিয়ে করেন। লক্ষ্মণের গর্ভে জন্ম হয় : প্রঘোষ, গাত্রবন, সিংহ, বাল, প্রবাল, উধরাবগ, মহাশক্তি, সাহা, ওজ ও অপরাজিতের ।
৭)মিত্রবিন্দ: অবন্তিকার (উজ্জয়িনী) রাজকুমারী মিত্রবিন্দার বিয়ের জন্য স্বয়ম্বর আয়োজন করা হয়েছিল। সেই স্বয়ম্বরে, মিত্রবিন্দ যাকে তার স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তাকেই বিয়ে করেছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণও সেই স্বয়ম্বরে উপস্থিত ছিলেন। মিত্রবিন্দ শুধুমাত্র ভগবান কৃষ্ণকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার ভাই বিন্দা ছিলেন দুর্যোধনের বন্ধু। তাই তিনি জোরপূর্বক ভগবান কৃষ্ণকে বেছে নেওয়া থেকে তার বোনকে বাধা দেন। শ্রীকৃষ্ণ মিত্রবিন্দের মনের কথা জানতে পারেন । অতঃপর ভগবান মিত্রবিন্দকে সকল প্রতিপক্ষের সামনে অপহরণ করে তাকে বিয়ে করেন। মিত্রবিন্দ ও শ্রীকৃষ্ণের সন্তানরা হলেন : বৃক্ষ, হর্ষ, অনিল, গৃহ, বর্ধন, অন্নদ, মহংস, পবন, বহিন এবং ক্ষুধী।
৮) ভাদ্র: শ্রীকৃষ্ণের শ্রুতকীর্তি নামে এক মাসী কৈকয় দেশে বাস করতেন। ভদ্র নামে তার একটি কন্যা ছিল। ভদ্র ও তার ভাইয়েরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুণাবলী জানতেন। তাই ভদ্রের ভাইয়েরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে তার বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর মাসি ও ভাইদের ইচ্ছা পূরণের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানে ভাদ্রকে বিয়ে করেন। ভাদ্রের সন্তানরা হলেন : সংগ্রামজিৎ, বৃহৎসেন, শূরা, প্রহরণ, অরিজিৎ, জয়, সুভদ্রা, ভামা, আয়ু ও সত্যক।
‘অষ্টভার্যা’ ছাড়াও শ্রী কৃষ্ণের আরও ১৬,১০০ জন স্ত্রী ছিল বলে জানা যায়। এই ১৬,১০০ জন স্ত্রীকে শ্রী কৃষ্ণ রাক্ষস নরকাসুরকে হত্যা করে মুক্ত করেছিলেন এবং তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন ।।