২০০৫ সালে, যখন সমাজবাদি পার্টির মুলায়ম সিং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং,সেই সময় তাজমহল ওয়াকফ বোর্ডের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। তার পর কি হল? তাজমহলকে ওয়াকফ বোর্ডের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হওয়া থেকে কীভাবে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল ? জানুন সেই কাহিনী :
আজ থেকে ১৯ বছর আগে মুসলিম ভোটের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় লড়াই কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টির মধ্যে লক্ষ্য করা গিয়েছিল । এই কারণে তাজমহল কিছু সময়ের জন্য ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যায়। ইউপিএ শাসনকালে মুসলমানদের খুশি করার জন্য ওয়াকফ আইন, জামিয়াকে মুসলিম ইউনিভার্সিটি, মুসলিম রিজার্ভেশন, সংখ্যালঘু মন্ত্রক, রঙ্গনাথ ও সাচার বাস্তবায়ন করছিল কংগ্রেস সরকার । এই দেখে তখন মুসলিম ভোটব্যাংক সুরক্ষিত করতে এগিয়ে আসে উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির সরকার । মুলায়েম বলেছিল যে তারা তাজমহলকে ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি করে দেবে ! তার এই ঘোষণার পর ২০০৫ সালের ১৩ জুলাই, উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের তরফে আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করা হয়েছিল। চেয়ারম্যানের নির্দেশ গেল ওয়াকফ বোর্ডের সিইওর কাছে। সেই নির্দেশে তাজমহল ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে নথিভুক্ত করার কথা বলা হয় । কলমের এক খোঁচাতে তাজমহল ব্যক্তিগত হয়ে গেল।
তখন উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন হাফিজ উসমান, তিনি তখন সমাজবাদী পার্টির বিধায়ক ছিলেন। তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতিও ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব বলেছেন,’রাজ্য সরকার ওয়াকফ বোর্ডের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।’ তিনি বলেন,’কারোর আপত্তি থাকলে তাদের আদালতে যেতে হবে।’ অর্থাৎ পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক তাজমহলকে তিনি ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছিলেন।
পপরিস্থিতি বেগতিক বুঝে এগিয়ে আসে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ অর্থাৎ এএসআই । এএসআই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় । ওয়াকফ বোর্ডের পক্ষে দাঁড়ান কংগ্রেস নেতা সালমান খুরশিদ । সুপ্রিম কোর্ট ওয়াকফ বোর্ডকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তাজমহলের মালিক যে শাহজাহান ছিলেন, তার নথি কোথায়? তাজমহলের মালিকানা ওয়াকফকে দেওয়ার নথি দেখালেই তাজমহল ওয়াকফকে দিয়ে দেবে বলে জানায় সর্বোচ্চ আদালত । তবে কাগজপত্র দেখাতে হবে। প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘আমাদের শাহজাহানের হাতের লেখা ও স্বাক্ষর সহ একটি কাগজ দরকার, যাতে ওয়াকফকে তাজমহল হস্তান্তর করার কথা বলা হয়েছে । কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি কবে স্বাক্ষর করেন ? কোথায় তার ইচ্ছার কথা লেখা হয়েছে ?
অবশ্যই কোনো কাগজপত্র ছিল না,তাই ওয়াকফ বোর্ডের আদেশ স্থগিত হয়ে যায়। ২০১৮ সালে, ইউপি ওয়াকফ বোর্ড তার দাবি প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাজমহল ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। ভারতের ভূমি। ভারত থেকে মার্বেল পাথর । সব কারিগর ভারতের। এখানকার মানুষ ঘাম ঝড়িয়েছে । এখানকার কৃষকদের কর থেকে নির্মাণ খরচ এসেছে । তার পরেও সম্পত্তি কি করে শাহজাহানের হয় ? শাহজাহান নিজের নামে জমিও রেজিস্ট্রি করেননি । এএসআই একটা সরকারি সংস্থা, তাই আইনি লড়াই চালাতে সক্ষম হয়েছিল । কিন্তু সাধারণ মানুষ কি ওয়াকফ বোর্ডের এমন দাবির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারবে? তবে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের পরিবেশ বদলে গেছে । দেশে অদ্ভুত জিনিস ঘটছে,যা কংগ্রেসের প্রায় ছয় দশকের শাসনকালে ঘটেনি । এখন ওয়াকফ বোর্ড কোনো গ্রাম বা দেবস্থান নিজের সম্পত্তি বলে দাবি করলে সেই মামলা আদালতে পৌঁছে যাচ্ছে । ওয়াকফ বোর্ড সংশোধনী আইন প্রণয়ন করার প্রক্রিয়াও চলছে।
প্রকৃতপক্ষে, দাবি করার ক্ষেত্রে কোনো সম্পত্তি কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যায় না । আগামীকাল লাল কেল্লা দাবি করা হবে । তাহলে কি লাল কেল্লা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হবে ? কংগ্রেস ওয়াকফ বোর্ডের পক্ষে একতরফা আইন করে গেছে। সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ভারতের জাতীয় গুরুত্বের ঐতিহাসিক ভবনগুলি ব্যক্তিগত নয়, ভারতীয় জনসাধারণের সম্পত্তি। তাজমহল ১৯২০ সালের ১৮ নভেম্বর, সরকারি আদেশ দ্বারা সরকারি সম্পত্তি। ভারত সরকার এই সম্পত্তি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে নিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, ওয়াকফ আ্যক্ট লিপিবদ্ধ হয় ১৯১৩ সালে, বৃটিশ জমানায়। পরে ১৯৫৫ সালে সেটি সামান্য সংস্কার করা হয়। ১৯৯৩ সালে এই আ্যক্ট নিঃশব্দে নীরবে সংখ্যার বিচারে কংগ্রেস সরকারের দ্বারা কালা কানুনে পরিনত হয়। পরে ২০১৩ সালে সেটিকে আরো একটু পরিমার্জন করে আক্ষরিক অর্থেই দেশের সাড়ে সর্বনাশ করে পাশ করিয়ে নেয় তদানিন্তন কংগ্রেস (সোনিয়া-মনমোহন জুটি) সরকার।
কি আছে সেই কালা কানুনে? কিছুই বিশেষ নেই এটুকু ছাড়া যে, যে কোনও দিন যে কোনও সময়ে যে কোনও সম্পত্তি ভারতভূমির (জম্মু ও কাশ্মীর ব্যতিরেকে) যে কোনও জায়গায় ওয়াকফ আইনের বলে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে নোটিশ, উচ্ছেদ ও দখল করে নিতে পারবে রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড বা কেন্দ্রিয় ওয়াকফ কাউন্সিল। অর্থাৎ কাল যদি আমার / আপনার বাড়িটা রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড মনে করে বা ‘বিশ্বাস’ করে যে, সেটি ওয়াকফ সম্পত্তি, তাহলে ঐ উল্লিখিত আ্যক্টের ৪০ ধারা অনুযায়ী তারা ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমাকে/আপনাকে উচ্ছেদ করে আমার বাড়ির দখল নিয়ে নিতে পারবে। এবং সমস্ত সরকারি ও প্রশাসনিক অফিসার সেই নোটিশের মান্যতা দিয়ে ওয়াকফ বোর্ডকে দখল করার জন্য সহায়তা দিতে বাধ্য থাকবে।
আমি কোনও আদালত বা আইনের দ্বারস্থ হতে পারব না। ওয়াকফ বোর্ড বা কাউন্সিলের বিরুদ্ধে কোনও আইনি প্রক্রিয়া চালু করা যাবে না। একমাত্র এবং শুধুমাত্র ওয়াকফ ট্রাইবুনালেই আমি আমার আপত্তি জানাতে পারি। আর সেই ট্রাইবুনাল, যা ওয়াকফ বোর্ডের পরামর্শেই গঠিত, যদি মনে করে যে, ওয়াকফ বোর্ড ঠিক কাজ করেছে তাহলে আমাকে আমার কষ্টার্জিত সেই বাড়ি ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতা এমন কি সর্বোচ্চ আদালতেরও নেই – ওয়াকফ বোর্ড বা কাউন্সিলের বিরুদ্ধে কোনও আ্যপিল ভারতের কোনও আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না।
পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে যে এখন ওয়াকফ বোর্ড তাজমহল কুতুবমিনার লালকেল্লা প্রভৃতি ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও নিদর্শনকেও নিজেদের বলে দাবি করছে এবং আরকিওলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার (ASI) হাত থেকে তাদের হাতে সমর্পন করার দাবি জানিয়েছে। সাম্প্রতিক আর একটা উদাহারন হল – বম্বের এবং ভারতের সবচাইতে বিলাসবহুল বাড়ি ‘আ্যনটিলা’ যা মুকেশ আম্বানির বলে আমরা সবাই জানি – সে বাড়িটি পর্যন্ত ওয়াকফ বোর্ড তাদের বলে দাবি করে নোটিশ পাঠিয়েছে। মুকেশ আম্বানি বলেই সেটির দখল এখনো নিতে পারে নি, কিন্তু ওয়াকফ বোর্ড যদি আদাজল খেয়ে লাগে তাহলে মুকেশ আম্বানিকেও উচ্ছেদ হতে হবে । যদিও এই আইনের বিরুদ্ধে একটি পিআইএল (PIL) নথীভুক্ত হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতে, ওয়াকফ আইন সংশোধন নিয়েও আলাপা আলোচনা চলছে,তাই আশা করা যাচ্ছে যে কংগ্রেসের এই কালা কানুন থেকে অব্যাহতি মিলবে ।।