শ্যামসুন্দর ঘোষ,পূর্বস্থলী,১২ জানুয়ারী : দিন চারেক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে‘ জানিয়েছিলেন যে ‘বাংলার ৯ লক্ষ কৃষককে সরাসরি তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩৫০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান শুরু করেছে‘ তাঁর সরকার । তিনি আরও লিখেছিলে, ‘ফসলের বিমার জন্য কৃষকদের কোনো টাকাও দিতে হচ্ছে না। কারণ, আলু, আখ সহ সব ফসলের প্রিমিয়ামের পুরো টাকাই রাজ্য সরকার দেয়।’ সেতো গেল প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ের বিষয় । কিন্তু স্বাভাবিক আবহাওয়ায় যেসমস্ত কৃষকরা তাদের ফসল ফলিয়েও যথাযথ মূল্য পাচ্ছেন না তাদের কি হবে ? যেখানে সংরক্ষণের পরিকাঠামোও নেই । ফলে মাঠ থেকে ফসল তোলার পর তা গবাদি পশুকে খাওয়াতে হচ্ছে ! কে দেবে তাদের ক্ষতিপূরণ ? এমনই প্রশ্ন তুলেছেন পূর্ব বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীর শব্জি চাষিরা ।
আসলে ভাগিরথীর তীরবর্তী কালনা মহকুমার পূর্বস্থলীতে শীতের মরশুমে প্রচুর শাকশব্জি উৎপাদন হয় । এই সময়ে কার্যত গোটা জেলায় শাকশব্জির চাহিদা মেটায় পূর্বস্থলীর চাষিরা । একটু লাভের আশায় বহু কৃষক বাঁধাকপি,ফুলকপি,আলু ছাড়াও বিভিন্ন শাকশব্জির চাষ করেন । কিন্তু ভরা শীতেও শাকশব্জির দাম না পেয়ে চরম অতান্তরে পড়েছেন এলাকার চাষিরা । ফুলকপি বিকোচ্ছে ১-২ টাকা পিস । বাঁধাকপির দামও তলানিতে । বিক্রি না হওয়ার কারনে আড়ৎদাররা ফুলকপি, বাঁধাকপির স্তুপ করে করে রেখে দিচ্ছে ফাঁকা মাঠে । আর তা খাচ্ছে গবাদি পশুতে । এমনই চিত্র দেখা গেল আজ রবিবার পূর্বস্থলীর ফলেয়া,সমুদ্রগর, পারুলিয়া, কালেকাতলা প্রভৃতি শব্জির বাজারগুলিতে । যদিও পূর্বস্থলীর ফলেয়ায় রাজ্য সরকারের তৈরী শব্জি সংরক্ষনের জন্য হিমঘরও রয়েছে । হিমঘরের ভবনে লাগানো আছে কুলার মেশিন । তবে ভবনে বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হিমঘরের দরজা ৷ খোদ রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের নিজের এলাকা পূর্বস্থলীর ফলেয়ায় হিমঘরের বেহাল দশায় তৃণমূল সরকারের মানসিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে । জমছে ব্যাপক ক্ষোভও । উল্লেখ্য, পূর্বস্থলী দক্ষিণের বিধায়ক স্বপন দেবনাথ রাজ্যের ক্ষুদ্র মাঝারি ও কুটিরশিল্প এবং প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের মন্ত্রী ।
পূর্বস্থলীর ফলেয়ায় রাজ্য সরকারের তৈরী শব্জী সংরক্ষন হিমঘর নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা । বেচারাম দাস নামে স্থানীয় এক চাষি বলেন,’শব্জী সংরক্ষন হিমঘর তৈরি হয়েই আছে, কিন্তু চালু হচ্ছে না । যদি চালু হতো তাহলে চাষীদের শব্জি নষ্ট হতো না এবং তারা ক্ষতির সম্মুখীন হত না। শব্জির পাইকারি বাজারে গিয়ে দেখুন চাষিরা খোলা মাঠে সমস্ত সবজি ফেলে মাথায় হাত দিয়ে বাড়ি চলে গেছে। এটা রাজ্য সরকারের উদাসীনতা ।’ তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন,’শাসকদলের নেতারা হয়ত ভাবছে ওই হিমঘরটা তৈরি করে দিলে তাদের পকেটে কাটমানি ঢুকবে না । তার জন্যই হয়তো ওই হিমঘর চালু করার বিষয়ে তাদের উৎসাহ নেই ।’ তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বড় বড় হোডিং এবং কোটি কোটি টাকা খরচা করে নেতা মন্ত্রীদের অনুষ্ঠান না করে এই ধরনেত হিমঘরগুলি চালু করার ব্যবস্থাও করত তাহলে অন্তত চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো না ।’ তিনি ওই হিমঘরটা অবিলম্বে চালু করা দাবি জানান ।
জানা গেছে,পূর্বস্থলীর ফলেয়ায় বেহাল হিমঘর নিয়ে স্থানীয় চাষিদের ক্ষোভ আঁচ করে গত মঙ্গলবার ও বুধবার পরিদর্শনে আসনে মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ, এসডিও ও বিডিও । তারা সমুদ্রগর, পারুলিয়া, কালেকাতলায় শব্জীর পাইকারি বাজার ঘুরে চাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথাও বলেন । আর তখন পূর্বস্থলীর ফলেয়া-মেড়তলা রেলস্টেশন সংলগ্ন দক্ষিনবঙ্গের একমাত্র শব্জি সংরক্ষন হিমঘরটি অবিলম্বে চালু করার দাবিতে সরব হন এলাকাবাসী। কিন্তু আজ পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি কাউকে ।
উল্লেখ্য,স্থানীয় চাষীদের অবিক্রীত ফসল সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রায় দু’দশক আগে রাজ্য সরকার কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে, পূর্বস্থলী থানার ফলেয়ার শব্জি বাজারের পাশে বিঘাখানেক জমিতে একটা হিমঘর তৈরী করা হয়েছিল । যেটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিয়ন্ত্রিত দ্বিতীয় হিমঘর । পরবর্তীতে, শুধুমাত্র সরকারী উদাসীনতার কারনে, তৈরী থাকা এই হিমঘরটি আর চালু হয়নি বলে অভিযোগ৷ রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের নেতারাও দীর্ঘ দেড় দশকে এবিষয়ে চাষীদের কোন স্থায়ী আশ্বাস দিতে পারেনি । স্থানীয় চাষিরা জানান,হিমঘরটি চালু করলে এলাকার চাষীরা ফুলকপি, বাঁধাকপি, আম, কাঁঠাল সংরক্ষন করে রাখতে পারতেন। ফলে তাদের লোকসানের মুখোমুখি হতে হত না প্রতিবছর । বর্তমানে ফুলকপি ও বাঁধাকপির উৎপাদন বেশি হওয়ায় চাষিরা তাদের ন্যাহ্য দাম পাচ্ছেন না । কিন্তু হিমঘরটি চালু থাকলে অসময়ে সেগুলি বিক্রি করে লাভবান হতে পারতেন । এখন দেখার বিষয় চাষীদের স্বার্থে এলাকার বাসিন্দা রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ এই বিষয়ে উদ্যোগী হন কিনা ।।