জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,২৭ এপ্রিল : ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর ওরফে পিকের কংগ্রেসে যোগদানের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার পর থেকেই ট্রেনে, বাসে, চায়ের দোকানে সর্বত্র কংগ্রেসকে নিয়ে একটা হাল্কা আলোচনা শুরু হয়েছে, যদিও আলোচনা সেভাবে গতি পায়নি । আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে সবার মুখে একটাই প্রশ্ন – এবার কি সর্ব ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? যেহেতু মানুষটার নাম প্রশান্ত কিশোর এবং বিগত বছরে তার সাফল্য যথেষ্ট ঈর্ষণীয় তাই প্রশ্নটা সংগত। বিভিন্ন মিডিয়ায় কংগ্রেসে তার যোগদানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হলেও,যদিও এখনো তিনি যোগদান করেননি এবং শেষ পর্যন্ত যোগদান করবেন কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে ইতিমধ্যে সোনিয়া গান্ধী সহ কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন শীর্ষ স্হানীয় নেতার সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে। তিনি নাকি কিছু শর্ত আরোপ করেছেন। সেগুলো পূরণ হলেই তিনি নাকি কংগ্রেসে যোগ দিতে পারেন। লেখাটা শেষ করার আগেই জানা যাচ্ছে পিকে কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেনা। তবে কংগ্রেসের মরা গাঙে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দ্যাখা গ্যাছে দায়িত্ব পাওয়ার পর, বিভিন্ন মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, পিকে দলের স্বার্থে তৃণমূল নেত্রীর কাছে কিছু টোটকা দিয়েছিলেন। নেত্রী সেই টোটকার অধিকাংশ মেনে নেওয়াতে দল তার সুফল পায়। যদিও অনেক নেতাদের গোঁসা হয়।
প্রথম পাঁচটা বছর ভাল ভাবে কেটে গেলেও কংগ্রেসের সমস্যা শুরু হয় কংগ্রেস পরিচালিত দ্বিতীয় ইউ.পি.এ সরকারের সময়। কংগ্রেসের এক শ্রেণির নেতার বিরুদ্ধে একের পর এক দূর্নীতির অভিযোগ ওঠে । জোট রাজনীতির স্বার্থে ইচ্ছে থাকলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। এরজন্য তাকে আক্ষেপ করতে দ্যাখা গ্যাছে। এটা ছিল সরকারের সমস্যা। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে রাহুল গান্ধীর অযাচিত হস্তক্ষেপ সমস্যাকে জটিল করে তোলে। সবকিছুর মিলিত ফল ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের পরাজয়। অথচ কংগ্রেস তখন প্রচুর জনহিতকর কাজ করেছিল। সেই যে রক্তক্ষরণ শুরু হলো এখনো সেটা বন্ধ হলোনা। এক সময় গোটা দেশ ব্যাপী রাজত্ব করা কংগ্রেস একটা আঞ্চলিক দলে পরিণত। মাত্র দু’টো রাজ্যে টিকে আছে এবং কতদিন থাকবে বলা কঠিন।
স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেস ধীরে ধীরে গান্ধী-নেহেরু পরিবারের পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত হয়। কংগ্রেসের নেতারা ঐ দুই পরিবারের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সোনিয়া গান্ধী নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখলেও রাহুল, আপাতত, পুরোপুরি ব্যর্থ। দলকে সঠিক দিশা দ্যাখানোর সঙ্গে সঙ্গে দলকে সঠিক পথে পরিচালনা করার প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। এমনকি প্রয়োজনের সময় রাজনৈতিক দূরদর্শীতার অভাব দ্যাখা গ্যাছে। সুযোগ থাকলেও মোটামুটি তারই ব্যর্থতার জন্য কংগ্রেস অসম, উত্তরাখণ্ড প্রভৃতি জায়গায় সরকার গড়তে পারেনি। এমনকি বিহারের ক্ষেত্রেও তিনি ভুল সিদ্ধান্ত ন্যান। পাঞ্জাব হাতছাড়া হয়। সভাপতির পদ ছেড়ে দিলেও কার্যত সিদ্ধান্ত তিনিই গ্রহণ করেন। দূরদর্শীতার অভাবের জন্যই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তিনি চরম ব্যর্থ। ফলস্বরূপ তার অনুগামী নেতারা দল ছাড়ছে।
একই কথা প্রযোজ্য প্রিয়াঙ্কা সম্পর্কে।ঠাকুমা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে চেহারার মিল দেখে প্রবীণরা কিছু দিনের জন্য আবেগে ভাসবেন। আবেগ কেটে গেলে বাস্তবের রূঢ় মাটিতে পা দিতেই হবে। তখনই হবে সত্যিকারের পরীক্ষা এবং প্রথম পরীক্ষাতেই তিনি ব্যর্থ। উত্তরপ্রদেশের একাধিক ঘটনা যোগী তথা বিজেপির বিরুদ্ধে এবং অখিলেশ যাদবের পক্ষে ছিল। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা নিজেকে এমন জনপ্রিয় মনে করলেন যে তার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে যারা এতদিন উত্তরপ্রদেশে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করছিল তারা দল ছেড়ে দিল। ভোটের ফল প্রমাণ করে দিল এতদিন তার সম্পর্কে যা বলা হচ্ছিল বাস্তবে তিনি তা নন। উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বে জোট ক্ষমতায় এলে পরবর্তীকালে বিভিন্ন নির্বাচনে লড়াই করা বিজেপির পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াত। সর্বভারতীয় দল হিসাবে কংগ্রেসের ফিরে আসার সুযোগ থাকত।
একটু ফ্ল্যাশ ব্যাকে ফিরে যাওয়া যাক। জরুরী অবস্থার কালো দিন অতিক্রম করে ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে। একদিকে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস এবং বিপরীতে দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল। ভোটে স্বাধীনতার পর কংগ্রেস প্রথমবারের জন্য ক্ষমতাচ্যুত হয়। ইন্দিরার উপর নেমে আসে একের পর এক রাজনৈতিক আঘাত। দল ভেঙে যায়। গড়ে তোলেন নতুন দল, আজকের কংগ্রেস (ই)। হতোদ্যম না হয়ে কার্যত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি ছুটে যান। মাত্র আড়াই বছরের মাথায় ১৯৮০ সালে পুনরায় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করেন রাহুল-প্রিয়াঙ্কার ঠাকুমা।
বিপরীতে রাহুল? বিজেপির বিরুদ্ধে ইস্যু আছে। আন্দোলন তুঙ্গে। হঠাৎ নিরুদ্দেশ। সম্ভবত দেশের মানুষ এখনো কংগ্রেসের উপর ভরসা রাখে কিন্তু রাহুলের উপর নয়। প্রিয়াঙ্কার মুখের মধ্যে ইন্দিরার মিল পাওয়া গেলেও আপাতত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা পাওয়া যায়নি। এরপরও কি মনে হয় ওদের দু’জনের হাত ধরে কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? দেশের বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলো শক্তিশালী হচ্ছে। এদের অধিকাংশ কংগ্রেস ভেঙে গড়ে উঠেছে। তারা রাজ্যে ক্ষমতায় থাকতে পারলেই সন্তুষ্ট। যদিও কেউ কেউ কট্টর কংগ্রেস বিরোধী। সবার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা জুটি কি সফল হতে পারবে? অপেক্ষা করতেই হবে।।